নার্সিসাস থেকে নার্গিস ফুল / শুবাচ

নার্সিসাস (Narcissus) বা নার্সিসিসি ডেফোডিল জাতীয় ফুল। বং বাংলায় এটি 'নার্গিস' ফুল নামে পরিচিত। গ্রিক পুরাণ (Myth) অনুসারে নার্সিসাস নামের একজন অপূর্ব সুন্দর যুবকের দেহ থেকে এই ফুলের জন্ম। এই যুবকের কাহিনির সাথে মিলে যাওয়া আচরণের নাম নার্সিজম বা নার্সিসিজম (Narcism or Narcissism) বাংলায় আত্মরতি, আত্মপ্রেম অথবা স্বপ্রেম। পল নাচ (Paul Nache) ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার sexual perversions নামক গবেষণায় নার্সিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ।
 
নার্সিসাসের পিতা নদীর দেবতা সিফিসাস (Cephissus) এবং মাতা লিরিউপি (Liriope) একজন পরী। নার্সিসাসের জন্মের পর তার মা তাকে নিয়ে গেলেন এক অন্ধ ভবিষ্য-বক্তার কাছে। উদ্দেশ্য ছেলের আয়ু জানা। ভবিষ্য-বক্তার নাম ছিল টাইরেসিয়াস (Tirasias)। টাইরেসিয়াসের জন্ম থেকে অন্ধ ছিলেন না তিনি ভবিষ্য-বক্তাও ছিলেন না। পুরুষ হয়েও একবার তিনি টানা সাত বছর নিজেকে নারীতে রূপান্তর করে রেখেছিলেন। এই সময় তিনি নারীদের সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। এর একটি হলো মিলনে নারীরা পুরুষদের থেকে বেশি পুলকিত হয়। যখন তিনি এই আবিষ্কারের কথা দেবরাজ জিউস ও তার স্ত্রী হেরাকে বললেন, হেরা খুব ক্ষেপে গেলেন এবং টাইরেসিয়াসকে অন্ধ করে দিলেন। এরপর তিনি তার দ্বিতীয় আবিষ্কারটি করলেন যে, সব নারীরা তার এ কথা শুনতে চাইবে না। টাইরেসিয়াসের অন্ধত্বের ক্ষতিপূরণ করার জন্য জিউস তাকে ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা প্রদান করেন।
 
নার্সিসাসের মা লিরিউপি অন্ধ টাইরেসিয়াসের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কতদিন বাঁচবে?’
টাইরেসিয়াস বললেন, ‘এই ছেলে একটা লম্বা জীবন পাবে কেবল যদি সে নিজেকে কখনও না দেখে’।
নার্সিসাস ছিল অসামান্য সুন্দর একটা ছেলে। জলপরী, বনপরী, ঝরনাপরী, সুন্দরী মেয়ে, এমনকি ছেলেরা পর্যন্ত তার প্রেমে পড়ত। কিন্তু সে কাউকেই পাত্তা দিত না। সবাইকে বলত, ‘তুমি আমার যোগ্য নও’। একবার এমিনিয়াস নামক এক যুবক নার্সিসাসের প্রেমে মজেছিল ভীষণ রকম। এই এমিনিয়াস তার আরও পুরুষ অনুরাগীদের ইতোমধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছে শুধু নার্সিসাসকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু নার্সিসাস ফিরিয়ে দিল তাকে এবং একটা ছুরি উপহার দিল। এর পেছনে নিশ্চয়ই গোপন কোনো ইচ্ছা ছিল। নার্সিসাসের গোপন ইচ্ছাও পূরণ হলো সেদিন, যেদিন এমিনিয়াস সেই ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করল নার্সিসাসেরই দরজার সামনে।
 
নার্সিসাসের প্রতি চরম অনুরক্ত একজন বনপরী হল ইকো (Echo)। ইকো মানে হল প্রতিধ্বনি। ইকো কথা বলতে পারত না। শুধু অন্যের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারত। তার এই অবস্থাও করেছেন জিউসের স্ত্রী হেরা। জিউস মাঝে মধ্যে বিভিন্ন পরীর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য অলিম্পাস পর্বত থেকে চলে আসতেন। তাদের অমতেও তিনি জোর করে হলেও মিলিত হতেন। হেরাও তার স্বামীকে ও যৌনসঙ্গী পরীকে হাতেনাতে ধরার জন্য অলিম্পাস থেকে একবার চলে এলেন। সেই সময় ইকো তার দীর্ঘ ও চমৎকার গল্প বলে হেরাকে ভুলিয়ে রাখল। এই ফাঁকে জিউস চম্পট দিতে পারল। হেরার সন্দেহ হলো যে, ইকো তার সাথে ফাঁকিবাজি করেছে। তাই তিনি বাচাল ইকোর কন্ঠস্বর কেড়ে নিলেন। তাকে অভিশাপ দিলেন যেন সে কখনও নিজে থেকে কথা বলতে না পারে। বোকার মতো মানুষের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারবে শুধু।
 
নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য। বনপরী ইকোও তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকত। ভাবত হয়তো একবার হলেও নার্সিসাস তার দিকে তাকাবে। একদিন নার্সিসাস যখন বনের মধ্যে ঘুরছিল তখন কারও পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। সে জিজ্ঞেস করল “কে ওখানে?” ইকো প্রতিউত্তর করল, “ওখানে...”। নার্সিসাস আবার বলল, “এদিকে এসো”। ইকো প্রতিউত্তর করল, “এসো...”। নার্সিসাস বলল, “তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেনো?...সামনে এসে আমার সাথে দেখা করো”। ইকো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল, কারণ স্বয়ং নার্সিসাস তাকে আহ্বান করেছে! তার কত আশা নার্সিসাসকে বলবে সে কে এবং তার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা শুধুই নার্সিসাসের জন্য রাখা। কিন্তু হায়! সে নিজে থেকে কথা বলতে পারে না। সে ছুটে গেল নার্সিসাসের দিকে এবং নিজেকে ছুঁড়ে দিল ওর বুকে।
 
নার্সিসাস খুব রেগে গেল। বলল, “সরো! আমি মরে যেতে রাজি আছি, তবুও তোমার হবো না!” এই বলে সে ইকোকে মাটিতে ফেলে দিল। ছোট ছোট গাছগুলো ভেঙে গেল ইকোর শরীরের চাপে। তার হৃদয় ভেঙে গেল। লজ্জায় অপমানে সে দৌড়ে চলে গেল পর্বতের দিকে। আক্ষেপ করতে করতে একসময় সে মরে গেল। পর্বতের পাথরের সাথে তার শরীরও লীন হয়ে গেল। শুধু রয়ে গেল তার কন্ঠস্বর, যা অন্যের উচ্চারিত শব্দকে অনুকরণ করে।
 
নার্সিসাস একইভাবে আরও অসংখ্য পরীকে আকৃষ্ট করল তার প্রেমিক-প্রেমিক আচরণ দিয়ে। কিন্তু শেষে তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সাথে দূরে সরিয়ে দিত। এভাবে অপমানিত হয়ে তারা মন থেকে চাইত যে, ভালোবেসেও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট কেমন তা নার্সিসাস একবার বুঝুক। এমন প্রত্যাখাতদের মধ্যে একজন একবার প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে প্রার্থনা করল, “হে দেবী নেমেসিস, নার্সিসাস যদি কখনও প্রেমে পরেও, সে যেন ভালোবাসা না পায়”। নেমেসিস প্রার্থনা শুনেছিলেন এবং নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।
 
একদিন অনেক রৌদ্রের সময় নার্সিসাস একটা জলাশয়ের ধারে এল। সে যখনই জলের দিকে তাকাল, দেখল এক অপূর্ব জলদেবতা জল থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারেনি যে ওই প্রতিবিম্ব তারই এবং সাথে সাথেই সে তার প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে গেল। নার্সিসাস নিচু হয়ে প্রতিবিম্বকে চুমো খেতে গেল। ওই প্রতিবিম্বও তাকে একইভাবে চুমো খেতে এল। এটাকে পারস্পরিক সম্মতি মনে করে নার্সিসাস তার প্রতিবিম্বকে জল থেকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়াল। জলে ঢেউ উঠতেই সেই অপূর্ব জলদেবতা চলে গেল। সে অস্থির হয়ে গেল। কোথায় চলে গেল তার ভালোবাসার মানুষ? যখন জল আবার স্থির হয়ে এল, জলদেবতাও ফিরে এল। নার্সিসাস তাকে জিজ্ঞেস করল, “কেনো? হে সুন্দর, কেনো তুমি আমার কাছে থেকে দূরে থাকো, কেনো আমাকে এড়িয়ে যাও? আমার চেহারা নিশ্চয়ই তোমাকে চলে যেতে বাধ্য করে না! পরীরা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে পাওয়ার জন্য তারা ব্যাকুল। তোমাকেও আমার প্রতি বিরক্ত দেখা যাচ্ছে না। যখন আমি আমার বাহু বাড়িয়ে দিই, তুমিও তাই করো। তুমি আমাকে দেখে হাসো এবং আমার মতো তুমিও মাথা নেড়ে সায় দাও”। 

আবার হাত বাড়ালো নার্সিসাস। জলদেবতাও আবার চলে গেল। জল ছুঁলেই জলদেবতা অদৃশ্য হয়ে যায়, এতে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে গেল। সে আর জলের দিকে হাত বাড়াল না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তার প্রতিবিম্বের প্রতি।
 
হতাশায় নার্সিসাস শুধু কাঁদত। যেহেতু সে কাঁদত, ইকোও তার সাথে কাঁদত। সে নড়াচড়া করত না, খেত না, কোন কিছু পান করত না। শুধু হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকল। অলীক প্রেমিকের শোকে তার শরীর শুকিয়ে যেতে থাকল, তার সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকল। যেসকল পরীরা তাকে ভালোবাসত তারা বারবার তাকে অনুরোধ করল সেই জলাধারের কাছ থেকে সরে আসতে। ইকোও তাদের সাথে সাথে অনুরোধ করল। কিন্তু নার্সিসাস যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত অটল রইল। চিরদিনের মত সে জলাধারের পাশেই বসে থাকার ইচ্ছা দেখাল। এভাবে ভুগতে ভুগতে একসময় ইকোর মত নার্সিসাসও মরে গেল। ধীরে ধীরে তার শরীরও অদৃশ্য হয়ে গেল। পরীরা শোকে বিলাপ করতে থাকল। যেহেতু পরীরা বিলাপ করতে থাকল, ইকোও তাদের সাথে বিলাপ করতে থাকল। আর মাটিতে মিশে যাওয়া নার্সিসাসের শরীর থেকে জন্ম নিল 'নার্সিসাস' বা 'নার্গিস' ফুল।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন