যবন / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

যবন শব্দের ব্যুৎপত্তি :

প্রাচীন ভারতে আলেকজান্ডার পরিচিত ছিলেন যবনরাজ হিসেবে। বেদ বিশ্বাসী ভারতীয়দের কছে বেদ-অবিশ্বাসী বিদেশি মাত্রই ছিল যবন। শব্দটি খাঁটি সংস্কৃত বলে মনে হয় না। এর ব্যুৎপত্তি (যু + অন(যুচ)-ক); অর্থ বৈদেশিক, বর্বর, ইউরোপীয়, ইংরেজি, মুসলমান, গ্রিক বা আইওয়ানবাসী ও বেগবান অশ্ব প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে ম্লেছ ও যবন সমার্থক। বৌধায়নশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ম্লেছরা গোমাংসভক্ষক, বিরুদ্ধভাষী সর্বাচারহীন অন্ত্যজ জাতি। এ থেকে অনুমান করা যায়, ভারতীয়রা গোমংস ভক্ষণ পরিত্যাগ করার পর ম্লেছ শব্দটির উৎপত্তি।
কালিদাস যবন বলতে গ্রিকদের বুঝিয়েছেন। আইওনিয়া (Ionia) বা প্রাচীন গ্রিস যবন শব্দের মূল উৎস। আইওনিয়া ফারসিতে ইউনান বা য়ুনান। এ ইউনান বা য়ুনান থেকে সংস্কৃত যবন শব্দের উৎপত্তি। প্রথমে যবন শব্দের অর্থ ছিল গ্রিকবাসী। কারণ তারা বেদ মানত না। গ্রিকদের ন্যায় ভারতের পশ্চিমের দেশগুলোর মানুষও বেদাচারী ছিল না। তাই গ্রিকদের মতো প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে তারাও ছিল যবন। এ জন্য আইওনিয়া, গ্রিস ও পরবর্তীকালে আগত আরবীয়, ইউরোপীয়, ইংরেজ সবাই যবন। শব্দটির আর এক অর্থ বেগবান অশ্ব। প্রাচীন গ্রিকরা বেগবান অশ্বে চড়ে এসেছিল বলে হয়ত ভারতীয় বৈয়াকরণরা শব্দটির এ রকম অর্থ নির্ধারণ করেছিল।
উপরের আলোচনায় যবন শব্দের চারটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথম: তারা বিদেশাগত ও বিভাষী, দ্বিতীয়: তারা বেদ মানে না বা বেদ বিশ্বাস করে না, তৃতীয়ত: তারা গোমাংস ভক্ষক ও সদাচারহীন এবং চতুর্থ : তারা বেগবান অশ্বারোহী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যবন শব্দটির চূড়ান্ত অপব্যবহার ঘটান। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে যবন শব্দকে মুসলমানের ব্যাঙ্গাত্মক প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তিনি যবনের চারটি বৈশিষ্ট্যই মুসলমানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন। সাহিত্যকর্মে ঋষি বঙ্কিমের এমন অঋষিসুলভ আচরণ বাঙালি এখনও ভুলতে পারে নি।

Comments

  1. ঋষি বঙ্কিম ! তারমতমিুস‌লিম বি‌দ্বেষী লেখক‌কে আরএকজন মুস‌লিম এই না‌মে ডাক‌তে পা‌রে না /

    ReplyDelete
  2. Mohammed Amin স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ সংক্ষেপে তথ্যবহুল ব্যাখ্যার জন্য। আমার জানামতে "পড়েছি মোঘলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।" যদি ধরে নিই "পড়েছি যবনের হাতে ..." থেকে "পড়েছি মোঘলের হাতে ..." এসেছে তাহলে, "যবন" যখন "মোঘল" হলো "ভাত" তখন "খানা" হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। আরেকটা জিনিসের সূত্র শক্তভাবে পেলাম না। "যবন" শব্দের উদ্ভব আগে হয়েছে বলেই কি "পড়েছি যবনের হাতে ..." প্রবাদটির উদ্ভবও আগে হয়েছে এমন কালানুক্রমিক সংযোগ স্থাপন করা যায় নাকি আরও কোনো সূত্র আছে? তাছাড়া ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রতিটি প্রবাদের পিছনে একটি করে মজার গল্প বা ইতিহাস থাকে। "মোঘল" হাতে পড়ে "খানা" খাওয়ার অত্যাচার সহ্য করার একটা বহুল প্রচালিত গল্প (ইতিহাস বললাম না) আমরা পাই। তো "যবন" এর হাতে পড়ার সাথে "ভাত" খাওয়ার গল্পটা কী? সেরূপ কোনো গল্প বা ব্যাখ্যা না থাকলে "পড়েছি মোঘলের হাতে ...." এটাই হলো এই প্রবাদের আসল রূপ আর "যবনের হাতে ...." ওটা হলো "মোঘল" এর "ক্যারিকেচার"। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  3. চমৎকার আলাপ। দীর্ঘদিন ধরে যবন শব্দটির ব্যুৎপত্তি খুঁজছিলাম।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন