বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বানানে সমতা / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুদ্ধ বানান চর্চা

বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও বানানে সমতা

ড. মোহাম্মদ আমীন
অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বাংলা বানানের অবস্থা রীতিমত আশঙ্কাজনক। একবিংশ
শতকের শিক্ষিত বাঙালিদের মাতৃভাষা জ্ঞান দেখলে উইলিয়াম কেরি নির্ঘাত হার্টফেল করতেন। বাংলা ব্যাকরণের সমৃদ্ধি ও বিজ্ঞানসম্মত অভিব্যক্তি বাংলাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তবু বাংলা বানানে উচ্চশিক্ষিত বাংলাভাষীদের  ভুলের অপরিণামদর্শী বহর লজ্জায় নুইয়ে দেয়। বাঙালি না বাংলাদেশী এখনও স্থির করা সম্ভব হয় নি, সেখানে বানান সমস্যা কীভাবে সমাধান  হবে? ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলে বাংলা ভাষা বিশ্ব সাহিত্যের সম্মানজনক স্থান অধিকার করে নেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবু আমাদের শিক্ষিত ব্যক্তিদের বাংলা বানান ভুলের বহর চরম অবিশ্বাসের প্রচণ্ড থাপ্পরে চোখ ছানাবড়া বানিয়ে দেয়।
উদহারণস্বরূপ শেরে বাংলা এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সির্টির ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ঈদকার্ডের ২১ শব্দের ফুটনোটটি নিম্নে উল্লেখ করলাম¬-মাননীয় চ্যান্সেলর, তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে শিক্ষার প্রধান উপকরণ ‘কলম’ তোলে দিচ্ছেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঠার শব্দের দুটি লাইনে এত ভুল এবং অসঙ্গতি তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে প্রকট করে তুলে। মাননীয় চ্যান্সেলরের গুরুত্ব পরিস্ফুট করার জন্য ‘তিন’ শব্দটির দ্বিত্ব ব্যবহার রমণীর সৌন্দর্য্য বর্ধণের জন্য সারা মুখে লিপাস্টিক লেপে দেয়ার মত হাস্যকর মনে হয়েছে। ‘অত্র’ শব্দের অর্থ ‘এই স্থানে’ বা ‘এখানে’ কখনও ‘এই/এ’ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ফুটনোটে ‘অত্র’ শব্দটিকে ‘এ’ অর্থ ব্যবহার করে যে অজ্ঞানতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তাদের বাংলা জ্ঞান সম্পর্কে কোণ ধারণা আছে বলে মনে হয় না। এরূপ সীমিত জ্ঞানের লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করলে কী রকম জিনিস বেরিয়ে আসবে তা সহজে অনুমেয়। ট্রেজার মোহাম্মদ আকবর আলী সিরাজী এত কম জ্ঞান নিয়ে যদি ট্রেজার হতে পারেন তাহলে আমাদের দোষ কী? বাক্যটির অর্থ- মাননীয় চ্যান্সলের তিন জন। তিন দিনের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে শিক্ষার উপকরণ ‘কলম’ তোলে দিচ্ছেন এই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার। এখানে মাননীয় চ্যান্সেলরকে মাননীয়তম করতে গিয়ে বাক্যটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে স্পষ্ঠ যে, মাননীয় চ্যান্সেলর বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নেই, আগে ছিলেন।

¯েপনের এক পাদ্রি ভারতবর্ষে  ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে তামিল অক্ষরে মালায়ালাম ভাষায় প্রথম বই মুদ্রিত করেন। এর দুইশ বছর পর ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে আমরা বাংলায় মুদ্রিত গ্রন্থ পাই। এ হিসেবে বিশ্বের চতুর্থ ভাষা বাংলা মালয় ভাষা হতে মুদ্রিত গ্রন্থের বয়স বিবেচনায় ২০০ বছর ছোট। জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড শ্রীরামপুর মিশনের মাধ্যমে প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের আমদানীর ব্যবস্থা করেন। মালয়ালাম ভাষা হতে দুশ বছর পিছিয়ে থেকেও বাংলা ভাষা ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে আনার যোগ্যতা অর্জন করে। বাংলা ভাষার এ অভাবনীয় সাফল্যের কারণ উচচশিক্ষিত ভাষাশিল্পীরা নন। স্বল্প অথচ স্বশিক্ষিত বাঙালিরাই এ কৃতিত্বের দাবিদার। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল কেউ বর্তমান ভাষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের ন্যায় মোটা মোটা গম্ভীর ডক্টরেট-ফক্টরেট ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন না। এমন কি বঙ্কিম, কায়কোবাদ, মীর মোশাররফ হোসেনও। আণ্ডার গ্র্যাজুয়েট মোহিতলাল মজুমদার ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। এবং তারা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির ভাররে ন্যুজ্য ছিলেন না বলে এত মেধা সম্পন্ন হয়েও রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করেন নি। এবং তাই বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করার মত অবদান রাখতে পেরেছিলেন। বর্তমানেও যে সকল বাংলাপ্রেমী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদান রেখে যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই স্বশিক্ষিত।

কেউ কেউ মনে করেন বাংলা বানানের জটিলতা মধ্যযুগের সৃষ্টি। তা ঠিক, কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কি নিজেদের এখনও মধ্যযুগের বলে মনে করেন? রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমান নিয়ে যদি বিশ্ব বসে থাকতেন তা হলে বোয়িং কি আসত? ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ছাপাখানার অভাবে বাংলা ভাষায় রচিত সবগুলো গ্রন্থ ছিল হস্তলিখিত। চর্যাপদ হতে শুরু করে মধ্যযুগে সৃষ্ট বিশাল সাহিত্যকর্মের কোনটি ছাপাখানার মুখ দেখে নি। একটি গ্রন্থ সাধারণভাবে সর্বোচ্চ ৫/১০ কপির বেশি করা হত না, ফলে প্রচার ছিল সীমিত। ক্ষুদ্র অঞ্চলের বাইরে গ্রন্থের বহুল প্রসারের কোন সুযোগ ছিল না। তাই তখন বানান ও উচ্চারণে এলাকা ও ব্যক্তিভেদে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হত। এখন ছাপাখানা, কম্পিউটার, টেলিভিশন, স্যাটেলাইট যুগেও যদি মধ্যযুগের সীমাবদ্ধতাকে অজুহাত করে শামুকের মত খোলসের ভেতর হাত গুটিয়ে বসে থাকা হয় তো, বাংলা ভাষার কপালে যথেষ্ট খারাবি আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ছাপাখানার মাধ্যমে বাংলায় পুস্তকাদি রচিত হবার পালা শুরু হলে লেখা ও মুদ্রণে বাংলা ভাষাকে প্রথমবারের মত একটি আদর্শমানের আওতায় নিয়ে আসার প্রয়াস নেয়া হয়। পর্যাপ্ত অবকাঠামো, রাজনীতিক অবস্থা ও বিবিধ কারণে তা সফলতার মুখ দেখে নি। তবে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্য ক্ষুদ্র অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে  বিস্তৃত পরিসরে চলে আসে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পার¯পরিক অদৃশ্য বোঝাপড়ার কারণে বানান কাঠামো আগের চেয়ে কিছুটা সার্বজনীন হয়ে উঠার পথ খুজে পেয়েছে। কিন্তু পেলে হবে কী? বাংলাভাষীরা মনে হয় সর্বজনীনতাকে পছন্দ করেন না, নইলে এক বিংশ শতাব্দীতেও কেন আমরা একটি আদর্শ বাংলা কি-বোর্ড করতে সক্ষম হই নি?

পৃথিবীর সর্বত্র একটি মাত্র কি বোর্ড দিয়ে ইংরেজি লিখন-মুদ্রণ স¤পাদন করা যায়। কোন ব্যক্তি পৃথিবীর যে প্রান্তে ইংরেজি টাইপ শিখুন না কেন, তিনি যে কোন মেশিনে যে কোন দেশে সচ্ছন্দে ইংরেজি টাইপ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তা কি সম্ভব? না, ইতোমধ্যে দশের অধিক বাংলা কি বোর্ড বাজারে চলে এসেছে। আও আসছে। মুনীর, প্রশিকা, বিজয়...  আরও কত কী, এ যেন বহুজাতিক কো¤পানির বিলাসদ্রব্য প্রস্তুত প্রতিযোগিতা। সৃষ্টি যে অনেক সময় মারাÍক অসুবিধার কারণ- তার একটি জঘন্য প্রমাণ বাংলাভাষার ডজনখানেক কি-বোর্ড। কেউ মুনীর শিখলে বিজয়ে কাজ করতে পারেন না, আবার বিজয় শেখলে মুনীর। দুটো শেখে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই, আমার এ লেখা শেষ হবার আগেই হয়ত কেউ আরেকটি  ‘কি-বোর্ড’ বাজারে চলে আসবে। আপনি কয়টা শিখবেন? কী-বোর্ড প্র্যকটিসে যদি সময় চলে যায় তাহলে কীবোর্ডের শেখার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে কবে?

এতদিন পরও বাংলায় একটি আদর্শ  কি বোর্ড  নির্বাচন করা সম্ভব হয় নি। ফলে শুধুমাত্র অবস্থাগত কারণে একজন দক্ষ অপারেটর কি-বোর্ড জনিত কারণে অদক্ষ হয়ে যেতে পারে। তা হলে আমাদের কি সবগুলো ‘কি-বোর্ড’ চালনা শিখতে হবে? তা সম্ভব নয়, সম্ভব হলেও শেখে অযথা শ্রম ঘন্টা নষ্ট করা হবে কেন? যেখানে এক লাফে নদী পার হওয়া সম্ভব সেখানে একাধিক লাফ দিয়ে নদী পারাপারকে বিলম্বিত করে তোলা চরম বোকামী। একাধিক বাংলা কি-বোর্ড আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির মারাÍক অন্তরায়। এটা একজন দক্ষকেও অদক্ষ করে তুলে। কারো কি বোর্ডে বিজয় ইনস্টল করা না হলে বিজয় কি বোর্ডে চরম দক্ষ কোন অপারেটর চরম অদক্ষ বলে প্রতিপন্ন হবে। এটা আমাদের ভাষার লিখন দক্ষতাকে কত নিচে নামিয়ে দিচেছ তা কি কেউ ভেবে দেখছি? আমার অফিসে আমি বিজয় করি, সহকারীরা মুনীর। প্রবলেম হয় যখন ফাইল স্থানান্তর হয় তখন, আমার ফাইলে তার এবং তাদের ফাইলে আমি কাজ করতে পারি না।

কি বোর্ডের মত বাংলা বানানেও সর্বজনসম্মত নিয়ম প্রচলনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ব্যর্থ। কোন বাংলা শব্দের বানান সঠিক হয়েছে কিনা তা অভিধান দেখেও নিশ্চিত হবার অবকাশও আর নেই। অভিধান দেখার পর প্রশ্ন উঠে আসতে পারে, কোন্ প্রতিষ্ঠানের অভিধান- বাংলা একাডেমীর না বাঙালা আকাদেমির, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওদুদের না হরিশ চন্দ্রের।



Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন