জীবনানন্দ দাশ / ড. মোহাম্মদ আমীন- শুবাচ
জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণা অধিবাসী। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৯৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে এসে বরিশালে বসবাস শুরু করেছিলেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক। প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবেও সত্যানন্দ দাশগুপ্ত খ্যাত ছিলেন। জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন বিখ্যাত কবি। বিখ্যাত কবিতা ‘আদর্শ ছেলে’
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে ---”
কবিতার লেখক ছিলেন জীবনানন্দ দাসের মা কুসুমকুমারী।
জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে আট বছরের মিলুকে ব্রজমোহন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগসহ ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রজমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেন। জীবনানন্দ কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় জীবনানন্দের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল ‘বর্ষ আবাহন’। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় বিভাগসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কিছুকাল আইনশাস্ত্রেও অধ্যয়ন করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেলে জীবনানন্দ তাঁর স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' শিরোনামের একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে কবিতাটি তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ঝরা পালকে স্থান পায়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’ প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পায়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্য ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তার উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন।
কলেজের আর্থিক দুরবস্থার করণে ‘ঝরাপালক’ প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে জীবনানন্দ দাসকে সিটি কলেজের চাকরি হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। কলকাতায় করবার মতো কোন কাজ ছিল না বাধ্য হয়ে তিনি বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে তিন মাস পর তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি চরম আর্থনীতিক দুর্দশায় পড়েছিলেন। জীবনধারণের জন্যে তিনি টিউশানি করতেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকায়, ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে। বিয়ের পর আর দিল্লিতে ফিরে যান নি। এরপর প্রায় পাঁচ বছর জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। মাঝে কিছু দিন ইনশিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন। ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনটা স্থায়ী হয়নি।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়। সে সময় তার ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কলকাতার সাহিত্যসমাজে কবিতাটি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। কবি নিজের বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়ে কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তবে জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশ করেন নি। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ গীতিকবিতা রচনা করেন যা পরবর্তীকালে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের প্রধান অংশ নির্মাণ করে। জীবনানন্দ এ কবিতাগুলো প্রকাশ করেন নি এবং তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে রূপসী বাংলা কাব্যটি প্রকাশিত হয়।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দূর্ঘটনায় কবি জীবনানন্দ দাশ আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। জীবনানন্দের চিৎকার শুনে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করেন। কবিকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে জীবনানন্দ দাসের মৃত্যু হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দসহ অনেকে মনে করেন, আত্মহত্যা স্পৃহাই ছিল দুর্ঘটনার কারণ। জীবনানন্দ গবেষক ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। উল্লেখ্য, গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ।
কবি জীবনানন্দ দাশ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবর্ষে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধও তিনি রচনা করেছেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে তিনি ১৪টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেন। যার একটিও জীবদ্দশায় প্রকাশ করেন নি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত।নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্য বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
Comments
Post a Comment