বর্ণপরিচয় / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

বর্ণ পরিচয়

বর্ণপরিচয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রাথমিক পুস্তিকা। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এবং একই বছর জুনে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ। প্যারীচরণ সরকার ও বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত করেন যে, তাঁরা ইংরেজি ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক পুস্তিকা লিখবেন। তদনুসারে প্যারীচরণ First Book of Reading এবং বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ প্রকাশ করেন। বিদ্যাসাগর মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পালকিতে বসে বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। দুই পয়সা মূল্যের এই ক্ষুদ্রাকার পুস্তিকার প্রকাশ ছিল বাংলার শিক্ষাজগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষার অযৌক্তিক শাসন থেকে মুক্ত করে যুক্তি ও প্রায়োগিক বাস্তবতায় বর্ণমালার সংস্কার-সাধনে প্রবৃত্ত হন। আজকের দিনে বর্ণক্রমিক ভাষাশিক্ষার পরিবর্তে বাক্যক্রমিক পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিশুর ভাষা শেখার যে স্বাভাবিক পদ্ধতি তার ওপর ভিত্তি করেই দেশে-বিদেশে এ পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। শতাধিক বছরব্যাপী শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এ বইটি প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এর পাশাপাশি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ এবং আরও পরে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা শিশুদের প্রথম পাঠ্য বই হিসেবে বহূকাল প্রচলিত ছিল।

বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পূর্বেও ছাপার অক্ষরে এই জাতীয় কিছু পুস্তিকা বাজারে ছিল। এ প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১), স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩ ?) ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫৪), ক্ষেত্রমোহন দত্তের তিন ভাগে রচিত শিশুসেবধি (১৮৫৪), মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থগুলোর কথা বলা যায়। তবে এই সব পুস্তিকা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি। কারণ বাংলা বর্ণমালায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কোন রূপ পুস্তিকাগুলোতে ছিল না।
বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষার পটভূমি পর্যালোচনা করলে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠে। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত শ্রীমন্তের শিক্ষারম্ভ থেকে ষোড়শ শতকের বাংলায় শিশুর শিক্ষার সূচনাপর্বের একটা চিত্র পাওয়া যায়। পাঁচ বছরের শিশুকে গুরুর পাঠশালায় হাতেখড়ি দেওয়া হত এবং সেখানে এই শিশু শিক্ষার্থী গুরুর কাছে মুখে মুখে এবং হাতে লেখা পুথি থেকে ভাষা, নীতি এবং জমিজমা ও ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব- নিকাশ, বাক্য, শ্লোক ইত্যাদি পড়ত, মূলত মুখস্থ করত। মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হওয়ার পর প্রথম একটি বাধা ছিল পাশ্চাত্যের যন্ত্রে মুদ্রিত গ্রন্থপাঠে জাত যাবে-এ রকম কুসংস্কার। অন্যদিকে দেখা যায়, রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১) বইটিতে বর্ণমালা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে ও বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮! যে কারো ক্ষেত্রে-শিশু বা বৃদ্ধ-শিক্ষাজীবন শুরু করার জন্য এ রকম ঢাউস ও গুরুগম্ভীর বই উপযুক্ত ছিল না।
বিদ্যাসাগরের আগে বর্ণমালা শেখার যে সকল বই প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশই শিশুর বাংলা প্রথম পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শ্রীরামপুর মিশনের লিপিধারা (১৮১৫), জ্ঞানারুণোদয় (১৮২০), রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শিশুবোধক, বঙ্গবর্ণমালা (১৮৩৫), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি, বর্ণমালা (১৮৪০), কলিকাতা স্কুল বকু সোসাইটির বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩), ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৪) এবং হ্যালহেডের এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজসহ (১৭৬৮) অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বিদ্যাসাগর-পূর্ববর্তী বাংলাভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ হিসেবে সবার আগে যে গ্রন্থটির নাম করতে হয় সেটি হচ্ছে, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯)। শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য বই।
আমরা জানি ব্রাহ্মীলিপি থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব। এ বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে, বিদ্যাসাগরের হাতেই প্রথম বাংলা বর্ণমালার বাস্তব ও প্রয়োগ-বান্ধব উন্নতি সাধিত হয়। বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় পুস্তিকায় বাংলা বর্ণমালাকে এমনভাবে সংস্কার ও সজ্জিত করেন যে, পরবর্তী সার্ধশত বছরে মাত্র কিছু সংস্কারমূলক কাজ করতে হয়েছে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হ্যালহেডের বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর মদনমোহনের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (প্রকাশকাল ১৮৪৯) পর্যন্ত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১৬ই ছিল। এগুলো হল: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋৃ, ৯, ৯৯, এ, ঐ, ও, ঔ, অ০, অঃ। বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২তে নামিয়ে আনেন। বিদ্যাসাগরের এই সংস্কারের ১২৫ বছর পর স্বরবর্ণে আর একটি সংস্কার ঘটেছে, তা হল ‘৯’ বর্ণটি বাদ দেওয়া। এখন স্বরবর্ণ ১১টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুনভাবে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেন। অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেখলেন, বাঙ্গালা ভাষায় একারের ত, ত্ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে। এটিকেও তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত করেন। ক্ষ যেহেতু ক ও ষ মিলে "সুতরাং এটি যুক্তবর্ণ। এ জন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।" এভাবে তাঁর হাতে ব্যঞ্জনবর্ণ হলো ৪০টি। এরপর ১২৫ বছরে কেবল অন্তস্থ ‘ব’ টি ব্যঞ্জন থেকে বাদ গিয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় পুস্তিকায় প্রথম শিশুদের উপযোগী সহজবোধ্য ও সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে পাঠ রচনা করা হয়েছে। প্রথমে শিশুরা বর্ণক্রমিক পদ্ধতিতে বর্ণ শিখবে, বর্ণের সঙ্গে মুখে মুখে ছোট ছোট শব্দ শিখবে, এরপর বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা, তারপর বর্ণযোজনা ও ফলা সংযোগে বানান শেখার সূচনা। এরপর রয়েছে সহজবোধ্য ছোট বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা। যা তৎকালীন বিবেচনায় অত্যন্ত বিজ্ঞানমূলক ছিল। বর্ণপরিচয়ের আগের পুস্তকসমূহে ছিল কঠিন ও অবোধ্য শব্দ। বিদ্যাসাগর পূর্বেকার অবোধ্য ও দুর্বোধ্য শব্দকদম্ব মুখস্থ করার পরিবর্তে শিশু পরিচিত সহজ ও স্বচ্ছন্দ বাংলা গদ্য রচনার মাধ্যমে শিশু শিক্ষার সূত্রপাত করেন। এভাবে বিদ্যাসাগর শিক্ষিত বাঙালির জন্য সহজ সাবলীল ও আধুনিক বাংলা গদ্যের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণপরিচয়ের পূর্বে বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রয়োগ নৈপুণ্য দেখা যায় নি। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ে সাবলীল স্বচ্ছন্দ গদ্যে যতিচিহ্নের ব্যবহার লক্ষণীয়। বর্ণপরিচয়ের ১৯ সংখ্যক পাঠ উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়-‘গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না; সকলের আগে পাঠশালায় যায়; পাঠশালায় গিয়া আপনার জায়গায় বসে; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে; যখন গুরু মহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে।’ বর্ণপরিচয়ের গদ্যাংশের মৌলিক সাহিত্য গুণ অনবদ্য। এখানে যে ২০টি পাঠ রয়েছে সেগুলোকে বাংলা শিশুসাহিত্যের সূচনাপর্ব বলা যায়। সহজ ভাষায় ছোট ছোট বাক্যে লেখা এ সকল বাক্যে ছবির মত নৈপূন্যে ফুটে উঠেছে সরল গদ্য, ছন্দোময় শিশুবোধ। যেমন- পথ ছাড়। জল খাও। হাত ধর। বাড়ী যাও। (২ পাঠ)। কথা কয়। জল পড়ে। মেঘ ডাকে। হাত নাড়ে। খেলা করে (৩ পাঠ)।
১৫০ বছর আগে লিখিত অথচ বিদ্যাসাগর তাঁর শিশুতোষ রচনায় কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেন নি। কাহিনীর সঙ্গে ধর্মের ও ধর্ম সংস্কারে সংস্রব নেই, জোর দিয়েছেন তিনি নীতিশিক্ষার ওপর, ভালোমন্দ বুঝে সচ্চরিত্র গঠনের ওপর। পুস্তিকাটি পড়লে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বিদ্যাসাগর আধুনিক শিক্ষক-শিক্ষণেরও পথিকৃৎ। তিনি পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু পরামর্শও লিখে গেছেন। বর্ণপরিচয়-এর দুটি ভাগেই বর্ণযোজনার নির্দেশিকা দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের ষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তিনি শিক্ষকদের জন্যই লেখেন, ‘প্রায় সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা, অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা সেরূপ না বলিয়া কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’
গ্রন্থটি যে শুধু বিদ্যাসাগরের জীবৎকালেই সমাদৃত হয়েছিল তাই নয়, গ্রন্থপ্রকাশের সার্ধ-শতবর্ষ পরেও এর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই গ্রন্থটিকে একটি প্রধান প্রাইমার হিসাবে অনুমোদন করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কলকাতা পৌরসংস্থার যৌথ প্রয়াসে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ভারতে বৃহত্তম যে বইবাসরটি (বই বিক্রির শপিং মল) নির্মিত হচ্ছে, তার নামও এই গ্রন্থটির সম্মানে বর্ণপরিচয় রাখা হয়েছে। ১৮৫৫ থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৮৯১) মোট ৩৫ বছরে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তিন বছরে ১১টি সংস্করণে ৮৮ হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ৩ হাজার কপি। সেকালের হিসাবে এ সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। ১৮৬৭ থেকে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৩ বছরে ১২৭টি সংস্করণে মুদ্রিত হয়েছে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার কপি। অর্থাৎ এ সময় বছরে গড়ে বর্ণপরিচয় মুদ্রিত হয় ১ লাখ ৪০ হাজার কপি।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন