লাইক / মোরশেদ হাসান -শুবাচ
লাইক
......................
লেখালেখির প্রক্রিয়া এখন কতই না সহজ হয়ে গেছে । আহা ! আগেকার দিনে যখন নবীন লেখকেরা একটি লেখা ছাপানোর জন্য প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জুতোর সুখতলি ক্ষয় করে ফেলে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরতেন এখন যুগের পরিবর্তনে টেকনোলজির সহায়তায় ঘরে বসেই আমার মতো এলেবেলে লেখক লেখা প্রকাশ করছে । জয়তু টেকনোলজী!
প্রথম প্রথম যখন লিখতাম তখন লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে ফেইস বুকে পোস্ট করতাম । কিছুক্ষণ পর পর ঘুরে-ফিরে পেজ ওপেন করে দেখতাম কেউ লাইক দিয়েছে কিনা । কমেন্ট দিলে সেতো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।
আমার ঘরের মানুষটি উদ্বিগ্নভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করতো,
-এই কেউ তোমার লেখায় লাইক দিয়েছে?
আমার জবাব দিতে ইচ্ছে করতো না । বেচারি আমার মুখ দেখে সব বুঝে নিয়ে মুখ কালো করে চলে যেতো । পরে একসময় দেখতাম দুটি লাইক জ্বলজ্বল করে জ্বলছে । আমি পরম আগ্রহে মাউস ধরে রেখে দেখতাম, কে এই দু’জন পরম বান্ধব?
ও হরি- একজন হলেন তিনি এবং আরেকজন তাঁর ছোট ভাই । আমি মুখ গম্ভীর করে ঘুরে বেড়াই । যাক বেচারি শত কাজের মাঝেও মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়ে লাইক দিয়েছে । গাঢ় ভালবাসায় আমার মন ভরপুর হয়ে যায় । একদিন আমি এই লাইক দেয়ার ইতিহাস হাড়ে হাড়ে হৃদয়াঙ্গম করে ফেললাম।
শুক্রবার ছুটির দিন । সকাল বেলা হৃষ্টচিত্তে ‘তারা’ চ্যানেলে ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ দেখতে বসেছি। মৈএী, মল্লিকা, রিনি এত সুন্দর উপস্হাপনা করে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । আজকে পল্লীগানের আসর । মেঠো সুরে আমার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে-
কোথায় পাবো কলসী কইন্যা, কোথায় পাবো দড়ি
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুইব্যা মরি।
গানের তালে তালে আমি মাথা নাড়ছি । ডুবে মরার কাহিনী যে আমার দিকেই ধেয়ে আসছে কিছুক্ষণ পরেই মরমে মরমে টের পেলাম।
সামনে ল্যাপটপ খোলা । গতকাল একটি লেখা পোস্ট করেছি।
আমার প্রিয় মানুষটি ঘুমঘুম চোখে আমার পাশে এসে বসলো । ফেইস বুকে আমার লেখাটি পড়ছে। আমি আড় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি । ইংরেজি ‘আর্থ কোঅ্যাক’ শব্দটির সাথে পরিচিত আছি কিন্তু ‘হার্ট কোঅ্যাক’ শব্দটির সাথে পরিচিত ছিলাম না । ‘হার্ট কোঅ্যাক’ - এ ধরনের একটি শব্দ আসলেই ডিকশনারিতে আছে । এর মানে হচ্ছে হৃদকম্প । আমার মোটামুটি হৃদকম্পের মতো অবস্হা হলো । কারণ আমার স্ত্রী প্রথম প্যারাটি পড়ার পর উুঁ উুঁ করে সর্বোচ্চ দু সেকেণ্ডে পরবর্তী পুরো লেখা পড়া শেষ করে দিল যাকে ইংরেজীতে বলে স্কিম করা এবং যথারীতি লাইক দিয়ে কোথাকার কোন এক বান্ধবীর ছবির নিচে গভীর মনোযোগ দিয়ে কমেন্ট লিখছে । মানুষ অধিক শোকে পাথর হয় আমি মোটামুটি মৈনাক পর্বত হয়ে গেলাম । গান শুনা আমার মাথায় উঠলো । এতক্ষণের পল্লীগীতির সুরেলা কন্ঠ প্রবল বেসুরো বলে মনে হলো । এই হলো লাইক দেয়ার কাহিনী।
আমি বললাম,
- এটা তুমি কি করলে? না পড়েই লাইক দিয়ে দিলে? এর মানে কী?
বেচারি কাঁচুমাচু হয়ে গেল । আমি আর কিছু বললাম না । ঝিম মেরে গেলাম । বেচারি দীর্ঘদিন মায়া করে আমাকে লাইক দিয়ে চলেছে । মায়া করে আমার সংসারের হাল ধরে রেখেছে । কারণ কোন লেখক সংসারী হয় একথা বললে যে কেউ বলবে,
–আস্তে কন, ঘোড়া ভি হাসবো।
অতএব যাঁরা লাইক পেয়ে খুশী থাকেন মনে রাখবেন এদের ৫০% না পড়েই আপনাকে মায়া করে চট করে লাইক দেন । কারণ আপনার লেখা পড়ার মতো সময় এদের নেই । এরা পরিচিত জনদের ছবি দেখতেই বেশী ব্যস্ত থাকেন এবং কমেন্ট করায় সীমাহীন খুশী হন । অনেকে পড়েন কিন্তু মনমতো তাৎক্ষণিক ভাষা না আসার জন্য বা ব্যস্ততার জন্য কমেন্ট না দিয়ে লাইক দেন । আর কতইবা ঘুরে ফিরে ঐ গৎবাঁধা ‘গুড’, ‘নাইস’, ‘অসাম’ এই গুটিকয়েক শব্দ ব্যবহার করা যায়। এই শব্দগুলো অতি ব্যবহারে এখন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে । এই শব্দগুলোর আরও প্রতিশব্দ নেই কেন এই নিয়ে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থেকে ধুর বলে মাউস স্ক্রল করে অন্যদিকে সরে যান । আর যাঁরা কমেন্ট করেন আশা করা যায় তাঁদের পড়ার ধৈর্য অসীম এবং আগ্রহ করেই লাইক দেন।
না, এত গবেষনায় যাবো না। তার চেয়ে গান শুনি । গানের সঙ্গে ভেসে যাওয়া মেঘের খেলা দেখি।
পাশেই বারান্দায় থাই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায় । ঘন মেঘমালা আকাশ । শুভ্র সাদা মেঘের ভেলা রোদসীর ভালবাসায় সেতুবন্ধন হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে দূর দিগন্তে । আমি গানের সঙ্গে ভেসে যাওয়া মেঘের খেলা দেখি । প্রজাপতির ডানায় ভর করে একফালি রোদ বারান্দায় বোগনভিলিয়া গাছের উপর পড়ে । সকালের মিষ্টি সোনাঝরা রোদ । গাছের পাতাগুলো রোদের স্পর্শ পেয়েই যেন সতেজ হয়ে উঠেছে । স্নিগ্ধ কোমল বাতাসের সঙ্গে সবুজ পাতাগুলো দুলে দুলে শুভ কোন বার্তার আগমণী সংবাদ দেয়।
Comments
Post a Comment