অভিধানভুক্ত শব্দের শুদ্ধাশুদ্ধতা ও ব্যাকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন

অভিধানভুক্ত শব্দের শুদ্ধাশুদ্ধতা ও ব্যাকরণ


অনেকে মনে করেন, অভিধানে কোনো একটি শব্দের যে কয়টি বিকল্প বানান থাকে সবগুলো শুদ্ধ। এ ধারণা ঠিক নয়। যে সকল শব্দ অতীতে ব্যবহৃত হতো কিন্তু এখন হচ্ছে না, বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে তবে শুদ্ধ নয় এবং শুদ্ধ- সবগুলো অভিধানে দেওয়া হয়। অভিধান ব্যাকরণ নয়, প্রমিত রীতিও নয়। যাঁরা অভিধান রচনা করেন তাঁরা বৈয়াকরণ হিসাবে অভিধান রচনা করেন না, আভিধানিক হিসাবে অভিধান রচনা করেন। যে সকল শব্দ প্রচলিত ছিল বা আছে সবগুলো অভিধানে না-দিলে বিভিন্ন বানানে লেখা শব্দের অর্থ-উদ্ধারে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই কোনো শব্দের যতগুলো বানান প্রচলিত ছিল বা আছে তা শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনা না করে অভিধানে উল্লেখ করা হয়। ব্যাকরণ কী?  ব্যাকরণের অনেক সংজ্ঞা রয়েছে, অনেক বিখ্যাত লোক ব্যাকরণের সংজ্ঞা দিয়েছেন। আমি সেসব সংজ্ঞার প্রতি যথাশ্রদ্ধা পোষণ করে বলছি, ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষা সম্পর্কে ভাষাভাষীর উপর নির্দেশিত একটি রীতি, যা তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও যথেচ্ছাচার হতে ভাষাকে রক্ষা করে।

অভিধান দোকানের মতো। ক্রেতা সাধারণের চাহিদা অনুযায়ী দোকানকে পণ্যসজ্জিত করা দোকানির কাজ। পণ্যের ভালোমন্দ বিবেচনার চেয়ে ক্রেতার চাহিদাই দোকানির কাছে মুখ্য। ক্রেতার স্বাস্থ্যের উন্নতি-অবনতির দিকে নজর দেওয়া দোকানির কাজ নয়। এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সিগারেট বা মদ্য স্বাস্থ্যহানিকর, তবু তা দোকানে রাখা হয়, বিক্রি করা হয়। দোকানি যদি ক্রেতার স্বাস্থ্য বিবেচনায় রত হয় তাহলে ব্যবসা লাটে উঠবে। অভিধানও ঠিক দোকানের মতো। অভিধানকে শব্দের গুদামও বলা যেতে পারে। গুদামে রাখা সব পণ্য মানসম্মত ও ভালো কিংবা স্বাস্থ্যকর তা বলা যাবে না। গুদামে ভালো, মন্দ, আংশিক ভালো, আংশিক মন্দ- সব রকমের পণ্য রাখা হয়। তাই গুদামে রাখা সব পণ্য মানসম্মত- এমনটি ভাবা যেমন সমীচীন নয় তেমনি সমীচীন নয় অভিধানে উপস্থাপিত সব শব্দ শুদ্ধ ভাবা। শব্দের শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনার জন্য রয়েছে ব্যাকরণ বা ভাষা-বিধি। কোনো শব্দ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ব্যাকরণ রীতি অনুসরণ না করলে তা অভিধানে যতই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, সেটি শুদ্ধ বলে গণ্য হয় না।

শুদ্ধাশুদ্ধ বিবেচনা না করে বর্তমানে প্রচলিত ও অতীতে প্রচলিত ছিল এমন সব শব্দের বানান অভিধানে রাখা অভিধান রচয়িতাগণের কর্তব্য। তাঁদের দায়িত্ব কেবল প্রচলিত শব্দের অর্থ উপস্থাপন, শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া নয় (কোন অভিধানে শব্দের শুদ্ধ-অশুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা থাকলেও তা ব্যাকরণ রীতির আলোকে দেওয়া হয়)। পাঠকের দায়িত্ব হচ্ছে বিচক্ষণতার সাথে প্রমিত রীতি অনুসরণ করে তা গ্রহণ-অগ্রহণ ও ব্যবহার।

সুতরাং, অভিধানে ‘কোনো শব্দের যতগুলো বানান উল্লেখ আছে সবকটি শুদ্ধ’ এমন ভাবা বিধেয় নয়। একই শব্দের একাধিক বানান উল্লেখের ক্ষেত্রে অভিধানে সাধারণত যে শব্দটি শুদ্ধ, প্রচলিত ও প্রমিত-রীতি অনুসরণ করে সেটি প্রথম লেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংক্ষেপে শব্দসমূহের অবস্থানগত বিবরণও দেওয়া হয়। তবু কোন বানানটি শুদ্ধ তা অভিধানে উল্লেখ না থাকলে জানার জন্য প্রমিত রীতি সম্পর্কে অবগত থাকা সমীচীন।

কোনো বিষয়, রীতি বা কার্যক্রম জনসাধারণের কাছে যতই জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, সরকারি নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তা বেআইনি বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে জন-চাহিদার স্বার্থে তার আইনানুগ স্বীকৃতি দিতে পারে। এভাবে আইন পরিবর্তন হয়, নতুন রীতির প্রবর্তন ঘটে। কোনো শব্দ শুধু ব্যাপক প্রচলনের কারণে যে শুদ্ধ হয়ে যাবে তা ঠিক নয়। ব্যাকরণবিধি অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ণ না-হলে অথবা বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রণকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ দ্বারা শব্দটির স্বীকৃতি না এলে তা অশুদ্ধই থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সার্বিক বিবেচনায় বহুল প্রচলিত শব্দটির বিষয়ে তাঁদের অবস্থান দ্রুত স্পষ্ট করা। অন্যথায় তাঁরা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন -এমনটি ভাবা যাবে না।

ভাষা বহমান নদীর মতো। তাই ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহে কোন পক্ষের প্রতিবন্ধকতা বা বলপ্রয়োগ মঙ্গলজনক হতে পারে না। প্রেমিক বা প্রেমিকার উদ্দেশ্য এবং ধর্ষণকারীর উদ্দেশ্য অনেকটা অভিন্ন হলেও উত্তরণের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাষাকে প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সাবলীল কলহাস্যে অভিষিক্ত করে বরণ করার আবহ সৃষ্টি করলে তা সার্বজনীন হয়ে উঠতে বাধ্য। কেউ যদি মাতৃভাষার প্রচলিত রীতি-নীতি আত্মস্থ করাকে কষ্টকর গণ্যে নিজের ইচ্ছেমতো তা পাল্টে দিতে চেষ্টা করেন সেটি ধর্ষণের মতোই বিব্রতকার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নিজের প্রতি প্রেমমুগ্ধ করতে না পারার কারণে তাকে জোরপূর্বক নিজের বাহুডোরে আনার চেষ্টা করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি ভাষাকে শুধু আত্মস্থ করতে না পারার কারণে জটিলতার দোহাই দিয়ে ব্যাকরণের রীতিনীতি অগ্রাহ্যপূর্বক তা বদলিয়ে ফেলার চেষ্টাও স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। আর একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যারা বিদ্যমান বিষয়কে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে নতুন কিছু গ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব থাকে তারা সে নতুন লভ্য বস্তুকেও দ্রুত পরিত্যাগ করার জন্য আরও বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠে। এটি অস্থিরতার লক্ষণ। এমন কর্ম উন্নয়নের মারাত্মক অন্তরায়। মড়ার আগে কাউকে মেরে ফেলা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মড়াকে আঁকড়ে ধরাও ঠিক নয়।
ভাষা পরিবর্তনশীল। চর্যাপদ হতে আধুনিক বাংলা ভাষার দিকে তাকালে এ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আমি ভাষার পরিবর্তনের বিপক্ষে নই। তবে তা হবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের মতো সাবলীল, ভালোবাসার মতো মোহনীয়, গ্রহণের মতো মুগ্ধকর। কখনও কোন অবস্থাতেই স্বেচ্ছাচারমূলক নয়।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন