আহমদ ছফার প্রবন্ধ : ত্রিকালদর্শীর বিমূর্ততা/ ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

আহমদ ছফার প্রবন্ধ


আহমদ ছফা নামটির মধ্যেই প্রাবন্ধিক অনুভূতির শৈল্পিক-কাকলী, যুক্তির উৎকর্ষ, পরিশীলিত চেতনা বিহ্বল আহ্বান, ঋদ্ধিক মননশীলতার চিরন্তন অনুভূতি, আত্মোপলব্ধিমুগ্ধ সার্বজনীনতা, পরিব্যাপ্তিময় সৌন্দর্য্যরে নিবিড় চেতনা এবং মুক্তবুদ্ধি-উজ্জীবিত সাহসী অনুরণন লালিত্য আগ্রহে ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে। তাঁর প্রবন্ধ সাহসিকতার অনল, তত্ত্ব-তথ্যের নিপূণ সমন্বয় এবং সতত প্রতীতির তৃপ্তিকর পুষ্টি। প্রতিটি কথা বাস্তবতার প্রমুগ্ধ গাঁথুনিতে প্রকৃতির মত নিপাট, ইতিহাসের মত নিখাদ। আহমদ ছফার প্রবন্ধ পাঠকমহলে আলাদা মর্যাদায় গৃহিত, বিশ্লেষক মহলে ভিন্নমাত্রায় স্বীকৃত। গবেষকদের কাছে তার প্রবন্ধ তুলনাহীন গ্রহণযোগ্যতার নন্দিত মোহনা। সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা এবং লুকোচুরিহীনতার জন্য তাঁর প্রবন্ধ যেমন আলোচিত তেমনি সমালোচিত। বস্তুত এটাই প্রবন্ধের সার্থকতা। এখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রাচার, সমালোচনা, জীবন, মুল্যবোধ, ধর্ম, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-আন্দোলন, দর্শন, নান্দনিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, গ্রাম, নগর, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ, চোরাচালান, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং পররাষ্ট্র ব্যবস্থাপনাসহ প্রাত্যাহিক জীবনের আরও অনেক বিষয় প্রকৃষ্ট কৌশলে হৃদয়গ্রাহী ভাষা আর মনকাড়া যুক্তিতে বিধৃত। নিঃসন্দেহে আহমদ ছফা একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাবন্ধিক। রচনাশৈলী আর প্রাবন্ধিক উপাদানের স্বয়ংস্পূর্ণতাময় তথ্যের জন্য আহমদ ছফা প্রথম থেকে বোদ্ধা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। উপমহাদেশের বাঙালি মননশীলতার সর্ব বিষয়কে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধটির বিকল্প এখনও দেখা যায় না। এ একটা প্রবন্ধ লিখেও যদি আহমদ ছফা থেমে থাকতেন, তবু তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রাববিন্ধক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন।

আহমদ ছফার বিখ্যাত কয়েকটি প্রবন্ধের মধ্যে বাঙালি মুসলমানের মন, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র, শিক্ষার দর্শন, রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি সাধনা, বার্টান্ড রাসেল, ভবিষ্যতের ভাবনা, বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে, একুশে ফেব্রুয়ারি ঊনিশ শ’ বাহাত্তর, বাংলার চিত্র-ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা, বাংলাভাষা: রাজনীতির আলোকে, বাংলার সাহিত্যাদর্শ, ভাষাবিষয়ক চিন্তাভাবনা, জীবনান্দ দাশ : তাঁর কাব্যের লোকজ উপাদান: সাম্প্রতিক নিরিখ, ফারাক্কা ষড়যন্ত্রের নানান মাত্রা, মাওলানা ভাসানী : ফারাক্কা গৃহদাহের রাজনীতি, মাদ্রাসা শিক্ষার কথা, অমৃতভা- মাইজভাণ্ডার, গ্রামের কথা, আনুষ্ঠানিক শিশুশিক্ষা প্রসঙ্গে, তাহলে এই হল গ্রন্থমেলা, একটি খোলা নালিশ, সাহিত্যের সুসমাচার, স্মৃতির দীয়া, কেন আমি বই মেলায় যাব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রক্রিয়া কতিপয় বিবেচনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি: সাম্প্রতিক পরিস্থিতি রেফারেন্ডামে দেওয়া হউক, শান্তিচুক্তি যেভাবে দেখি, আওয়ামীলীগ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ, ভারতে বিজিপির উত্থান এবং তারপর, ছাতা মাথায় নির্মল সেন আমি তাকে ভোট দেব, চোরাচালান, উত্তরবঙ্গ: সীমান্ত অর্থনীতি, সালমান হায়দারের সাংবাদিক সম্মেলন প্রসঙ্গ: কতিপয় বক্তব্য, আমলারা নিজেরা একটি পার্টি, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং ফারাক্কার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, বিদ্যুৎ কেনার আগে পাঁচবার ভাবতে হবে, আসামের দিকে তাকাতে হবে, কবি শামসুর রাহমান আমার সম্পর্কে যা বলেন এবং বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ সকল প্রবন্ধের প্রাঞ্জল বর্ণনার যৌক্তিক স্বকীয়তার সাবলীল বুদ্ধিমত্তায় অনন্য। প্রবন্ধগুলো বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য সংযোজন। বিষয় ও বর্ণনায় মুগ্ধকর প্রবন্ধসমূহের জন্য বাঙালি জাতি আহমদ ছফার কাছে চিরঋণী।

আহমদ ছফার প্রবন্ধ পাঠ করলে পাঠক মাত্রই আবেশঘণ অনুভূতির তীব্র প্রশ্নে জেগে উঠেন। হৃদয়মন আত্ম-উপলব্ধির নব চেতনায় মগ্ন হয়ে পড়ে মধুর আলেখ্যে। স্বল্প পরিসরে বিশাল বিষয়কে পরিপূর্ণ অনুধাবনময়তায় প্রকাশ করার ক্ষমতা বিবেচনায় আহমদ ছফা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেরও একজন শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক। শুধু প্রবন্ধ কেন, উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প ও রম্য রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। যদ্যপি আমার গুরু, ওঙ্কার, সূর্য তুমি সাথী প্রভৃতি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নুতনমাত্রা সৃষ্টি করেছে। বাংলা সাহিত্যে কয়েকজন শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিকের নাম বললেও নিরপেক্ষ বিচারে আহমদ ছফার নাম এসে যায়। তবে দশটি প্রবন্ধের নাম বললে দুটির মালিকানা এসে যায় আহমদ ছফার কাছে- একটি ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ এবং অন্যটি - বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। তার প্রবন্ধ যেন ষড়ঋতুর সোহাগ, সোনালী সূচনার অবগাহনে ক্রমান্বয়ে আকর্ষণীয় সঞ্চরণের বিহবল পরিক্রমায় তৃপ্তিময় সমাপ্তি। এ পরিচ্ছেদে বর্ণিত প্রবন্ধদ্বয় কেউ ভালভাবে অনুধাবন করতে পারলে তার কাছে বাঙালি, বাঙালি মুসলমান আর বাঙলার সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু অজানা থাকার কথা নয়। এমন যৌক্তিক ও প্রাণবন্ত প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে আর নেই। স্বল্প পরিসরের তিনি বাঙালি মুসলমানের মন ও বুদ্ধিজীবীগণের মানসিকতাকে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার বিদ্যমান পরিপূরকে যে নিপূণতার সাথে তুলে ধরেছেন তা সত্যি বিস্ময়কর। আহমদ ছফা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে তা সহস্রাধিক পৃষ্ঠার গ্রন্থেও প্রকাশ করা সম্ভব হত না।

প্রবন্ধ রসকসহীন তত্ত্ব-তথ্যের ভয়ঙ্কর শব্দবন; বিচরণ কষ্টসাধ্য, আহরণ বিরক্তিকর- এমন অভিযোগ প্রায় শুনা যায়। আহমদ ছফার প্রবন্ধ এরূপ অভিযোগ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাঁর প্রবন্ধ আকর্ষণের সজীবতা; তথ্যে আগ্রহ, তত্ত্বে সারল্য, বিবর্ণনে সততা, প্রকাশে উদ্দীপনা, পরিবেশনায় মুক্তবুদ্ধির অজেয় বিজয় এবং উপসংহারে প্রাপ্তির আনন্দ পাঠককে অন্য জগতে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে প্রতিটি প্রবন্ধ প্রাণকাড়া শব্দবাগান। বিচরণ মোহনীয়, প্রাপ্তির আনন্দ, সুখকর উপভোগের নান্দনিক বিমূর্ততা। বিষয় আকর্ষণীয় হলেও উপস্থাপনের কারণে অনেকের প্রবন্ধ পঠন আর অনুধাবনে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়। আহমদ ছফার চয়ন কৌশল তুলনাহীন। যেখানে যতটুক প্রয়োজন ঠিক ততটুক রস, ততটুক তথ্য, ততটুক যুক্তি এবং ততটুক বর্ণনা। কোথাও বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন নেই। নিখাদ রমণীয়, ষোড়শীর চর্বিহীন অবয়ব। যা কোনরূপ প্রয়াস ব্যতিরেকে প্রকৃতির মত নিবিড় অবহেলার শ্যামল আলেখ্যে ব্যাপ্ত। তাঁর লেখা প্রকৃতিময় সহজাত প্রবৃত্তিতে পাঠককে নিবিড় আগ্রহে টেনে রাখে। রান্না ও পরিবেশনার কারণে অনেক ভাল খাদ্যও অখাদ্য হয়ে উঠে। আবার রন্ধন ও পরিবেশনার গুণে সাধারণ মানের খাবারও হয়ে উঠে অসাধারণ। পরিবেশনার অপূর্ব কৌশলের কারণে যে কোন সাধারণ বিষয়ও আহমদ ছফার প্রবন্ধে অসাধারণ হয়ে উঠে। জ্ঞান, গরিমা, বুদ্ধি, সাহস, বিচক্ষণ পরিবেশনা, ছন্দময় আবহ-অনুরাগ, তীক্ষ্ম-সময়বোধ, প্রগাঢ় ঐতিহাসিকতা, নিষ্ঠাময় বাস্তবতার কোড়ক এবং সৃজনশীল তুলিকাব্যের নির্ভয় পদচারণা আহমদ ছফার প্রবন্ধগুলোকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক, লেখক এবং সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন তন্মধ্যে আহমদ ছফাই সবচেয়ে সাহসী, বুদ্ধিমান, স্বতস্ফূর্ত, নির্লোভ, ঋদ্ধ, কুশলী, বহুমুখী এবং তেজময়। নির্লোভ মননশীলতা এবং সত্যসমৃদ্ধ স্পষ্টবাদিতার জন্য তাঁকে ভয় পেতেন না এমন কোন বাঙালি ছিলেন না; এমনকি তাঁর শিক্ষকগণ পর্যন্ত। তাঁর প্রবন্ধে গবেষণার ঐকান্তিকতা, ইতিহাসের নিবিড়তা, কাব্যের প্রাণবন্ততা, উপন্যাসের বিমূর্ততা আর নাটকের পরিণতি ত্রিকালদর্শীর মত চিরন্তন, সতত বর্তমান এবং সংগতকারণে সার্বজনীন। ধর্ম তাঁর কাছে ফেলনাও নয় আবার ধনকাতুরে সুখলোভী মানুষের মত আকর্ষণীয়ও নয়। আধুনিকতার বিনির্মাণে এর কোন ভূমিকা তাঁর চোখে পড়ে না। তিনি রাজনীতিকে ধর্মের উন্নত সংস্করণ মনে করেন। রাজনীতির মতই ধর্ম মানুষের তৎকালীন প্রাত্যাহিক সমষ্টিগত প্রয়োজনীয়তা মেটানোর স্বার্থে গৃহিত।

তবে তিনি ত্রিকালদর্শী। তার প্রবন্ধই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। একজন মানুষের একই সময়ে ত্রিকালদর্শী হওয়ার যে সকল উপাদান আবশ্যক সব কটি আহমদ ছফার ছিল। ত্রিকালদর্শীর প্রবন্ধ ত্রিকালেরই ছায়া। তাই তাঁর প্রবন্ধ কালজয়ী বাণী এবং বিদগ্ধ অনুসন্ধানের প্রশ্নময় কথকতা। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে এখনও আহমদ ছফাকে টেক্কা দেওয়ার মতো কেউ জন্মায় নি। তাঁর প্রবন্ধগুলো বাংলা সাহিত্যের মর্যাদা, প্রবন্ধজগতের আকড়। মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনে এমন কোন বিষয় নেই যা তাঁর প্রবন্ধের ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠে নি।বর্তমান প্রজন্মকে বাংলাদেশ, বাঙালি এবং বাঙালি সমাজ ও আর্থ-রাজনীতিক এবং সামাজিক বিবর্তন সম্পর্কে সত্যিকার অনুবোধে সৃজনশীল হয়ে উঠার অনুকূলে আহমদ ছফার এ প্রবন্ধ সংগ্রহ পাঠের বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

প্রবন্ধকে যদি শরীরের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে আত্মজ্ঞান-নিবিড় প্রকৃষ্ট অনুসন্ধানের পক্ষপাতহীন যোজনা আহমদ ছফার প্রবন্ধের অবয়ব, নির্লোভ আভিজাত্যের সাহসী উচ্চারণ মাংশপেশী, দুরদর্শী চেতনার শালীন বাক্যবান তার শক্তি, জাগড়নময় অনুভবের প্রীতম অনুবন্ধন হৃদপিণ্ড, বাস্তবতার নিরিখে অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের মুক্তবুদ্ধিঘণ সমন্বয় মস্তিষ্ক এবং আকর্ষণীয় বাক্যের মন্দ্রিত প্রাঞ্জলতা তাঁর প্রবন্ধের সৌন্দর্য। এমন সৌকর্ষময় বিকাশ আর হয় না। প্রবন্ধ সংগ্রহের প্রতিটি প্রবন্ধ বিষয়ভিত্তিক ঋদ্ধতার অনবদ্য ফসল। প্রতিটি প্রবন্ধের বর্ণনায় না গিয়ে একটি কথায় বলা যায়, আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যের আদর্শ প্রবন্ধের ভিত্তি। কেউ যদি কয়েক পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ পড়ে কোন বিষয়ে নিবিড় জ্ঞান অর্জন করতে চান তাহলে তার জন্য সহজ ও বিচক্ষণ উপায় হচ্ছে আহমদ ছফার প্রবন্ধ পাঠ।


Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন