শব্দে পুরুষাধিপত্য / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ
স্ত্রীবাচক শব্দে পুরুষাধিপত্য
পুত্র শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে উদ্ধার করে বলে ছেলে সন্তানের নাম পুত্র। তা হলে কন্যার ব্যুৎপত্তি কী? সে কাউকেই ত্রাণ বা উদ্ধার করতে পারে না, বরং তার কাছ থেকে জন্মদাতা ত্রাণ চায়। কন্যার মতো শব্দটিকেও কামনার রেশ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাভারতে ব্যাসদেবের ব্যাখ্যা দেখুন : সর্বান্ কাময়তে যস্মাৎ (৩.৩০৬.১৩)। এর অর্থ ‘কন্যা মানে ‘কাম্যা’। কন্ আর কম্ কুটুম্ব ধাতু। ‘ভগিনী’ শব্দটির অর্থ ভগাযুক্ত, অনেকে সরাসরি স্ত্রীচিহ্ন-ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করেন। আলংকারিক কবি দণ্ডী ভগিনী শব্দকে জুগুপ্সাব্যাঞ্জক বলেছেন, সাহিত্যে শব্দটির ব্যবহার থেকে বিরত থাকতেও বলেছেন - ভগিনী-ভগবত্যাদি গ্রাম্যকক্ষাং বিগাহতে। পুরুষের সমকক্ষ হয়েও কন্যা কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদের দাবিদার হবে তা ছিল কল্পনারও বাইরে। এ জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ, প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান, মন্ত্রী ইত্যাদির স্ত্রীলিঙ্গের কথা ভাবাই হয় নি। ভার্যা নামটাই অবমাননাকর। তার উপর যৌনতা আরোপিত হওয়ায় ‘ভার্যা’ যখন পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র ( পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা) হয়ে দাঁড়ায় তখন সত্যি কষ্ট হয়। কত জঘন্য ছিল তখনকার সমাজপতিরা। অঙ্গনা, রমণী, কামিনী, ললনা, প্রমদা, যোযা, যোযিৎ, বনিতা এরূপ অসংখ্য নামেই নারীদের ডাকা হয়। কিন্তু কোনটিতে নারী হিসেবে নারীর মর্যাদা দেওয়া হয় নি। এটি প্রাচীনকালে নারীদের প্রতি পুরুষ-শাষিত সমাজের নির্লজ্জ জুলুম ও চরম আধিপত্যবাদী নৃশংস মনোবৃত্তির পরিচায়ক। এখনও অনেকের মধ্যে এরূপ ঘৃণ্য আচরণ লক্ষণীয়।
এবার শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ করা যাক। অঙ্গনা শব্দে অঙ্গসৌষ্ঠবের আকর্ষকতাকে প্রকট করে তোলা হয়েছে। ‘রমণী’ শব্দটি যে রমণের ঈঙ্গিতবাহী তা-তো সবাই জানেন। এ প্রসঙ্গে কবিকঙ্কণের একটি লাইন, ‘রমণে রমণী মরে কোথাও না শুনি।’ ‘কামিনী’ শব্দ কম্ -ধাতুজ্, কামনারই ধন, ব্যাখ্যা করা হয়েছে অত্যন্ত কামুকী হিসেবে। কাশীরাম লিখেছেন, ‘কামিনী দেখিয়া কামে হইল বিভোর।’ ললনা মানে বিলাসিনী, পুরুষকে যে লুব্ধ করে ছলাকলায় (লালয়িত পুমাংসম)। ‘প্রমদা’ শব্দে আছে মাদকতার কথা। ‘যোযা’ ও যোযিৎ’ ললনার অর্থবাহী অর্থাৎ বিলাসিনী, পুরুষকে যে প্রলুব্ধ করে। ‘স্ত্রী’ শব্দে গর্ভধারণের বিষয়টাই ছিল মুখ্য। ‘স্তৈ’ ধাতুর মূলে, স্ত্যায়তে শুক্র শোণিতে য়ম্যাস্, যার অর্থ ‘শুক্রশোণিত যাতে কাঠিন্য পায়’। শুধু সংস্কৃত ভাষায় নয়, ইংরেজি ও ল্যাটিন ভাষাতেও নারীদের প্রতি এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ করা হয়েছে। ল্যাটিন sator শব্দের সঙ্গে স্ত্রীর উচ্চারণ-সাম্য লক্ষণীয়। ল্যাটিন শব্দটির অর্থ begetter । স্ত্রীবাচক ‘দার’ শব্দটির মূল অর্থ কৃষ্টভূমি। নারীও ভূমিকল্পা, বীজ-বপনে সন্তান-শস্য উৎপাদিকা।
ইংরেজিতে দেখুন, woman, mistress, madam কোন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস নারী-পুরুষ সাম্য ও মর্যাদা বিবেচনায় শোভনীয় নয়। প্রকৃতপক্ষে woman এসেছে wifeman থেকে। যেখানে নারীর কোন স্বতন্ত্র পরিচয়কে মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরা হয় নি। এখানে নারীর পরিচয় কারও স্ত্রী হিসেবে। mistress শব্দের আদি ও উৎসার্থ ছিল অবৈধ প্রেমিকা, শব্দটা বর্তমান অর্থে আসতে বেশ সময় নিয়েছে। madam (<ma dam = my lady) শব্দটি আগে স্ত্রীলোকের প্রতি প্রণয় সম্বোধন হিসেবেই ব্যবহৃত হত, চসার এর সময়েও শব্দটির অর্থের অবনতি ঘটে নি। Restoration আমলে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শব্দটির অর্থের অবনতি ঘটে এবং অর্থ দাঁড়ায় বেশ্যাবাড়ির মালকিন, অর্থাৎ আমরা যাকে মাসি বলি। এখন শব্দটির যথেষ্ট অর্থোৎকর্ষ ঘটেছে। বর্তমানে madam অতি সম্মানসূচক সম্বোধনে ব্যবহৃত একটি বহুল প্রচলিত মর্যাদাকর শব্দ।
কাউকে হেয় করার জন্য নয়, প্রকৃত বিষয় জ্ঞাপনই পোস্টটির উদ্দেশ্য, তবু কেউ আহত হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
Comments
Post a Comment