ভাত এল কোত্থেকে / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

ভাত


কারও কারও মতে সংস্কৃত ‘ভক্ত’ থেকে প্রাকৃত ‘ভত্ত’ এবং সেখান থেকে ‘ভাত’ শব্দের জন্ম। আবার অনেকে মনে করেন ‘ভাতার’ শব্দ থেকে ‘ভাত’। বিষয়টা পর্যালোচনা করা যাক। ‘ভাত’ বলতে সে সব বিষয় বা বস্তু বুঝায় যা অন্নরূপে শোভা পায়। সিদ্ধ তণ্ডুল, অন্ন, অন্নপ্রাশন, জীবিকা, দীপ্তি পাওয়া, প্রকাশ পাওয়া, শোভা পাওয়া প্রভৃতি অর্থও শব্দটি প্রকাশ করে। ‘ভাত’ এর সঙ্গে ‘ভাতা, ভাতার, ভাতারকামড়া, ভাতার খোর, ভাতারখাগী, ভাতারনড়, ভাতারী’ প্রভৃতি শব্দের সম্পর্ক বেশ নিবিড়। ভাতা = ‘ভাত’-এর আধার যাতে; বেতন ব্যতিরেকে কর্মচারীদের অন্যত্র যাতায়াত ইত্যাদির জন্য প্রদেয় বৃত্তিকেও ‘ভাতা’ বলে; এর সঙ্গেও ভাতের সম্পর্ক রয়েছে। ভাতার = ভাতা রয় যাতে; পতি অর্থেও ভাতার (স্ত্রীভাষায়) প্রচলিত, কারণ পতি ‘ভাত’ দেয়।। ভাতারী = ভাতারকে সক্রিয়ভাবে ধারণ করে যে, ভাতারের স্বামী বা যে ‘ভাত’ দেয় তার আধার। ‘ভাতারকামড়া’ শব্দটি প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। এর অর্থ, যে স্ত্রী ভাতারকে কামড়িয়ে থাকে অর্থাৎ ছাড়তে চায় না। ‘ভাতারখোর’ বলতে বুঝায়, সে স্ত্রী, যে ভাতার (স্বামী) এর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল এবং ভাতার ভিন্ন আর কোন উপায় নেই; তাই ভাতারকে ছাড়তে চায় না। আবার ‘ভাতারখোর’ বলতে তৎকালে প্রচলিত (কুসংস্কারের কারণে) যে স্ত্রীকে স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে অপয়া গালি দেওয়া হত তাকেও বোঝায়। ভাতারখাগী বলে একটা শব্দও প্রচলিত ছিল, এটি সধবার প্রতি অকল্যাণসূচক গালি; যার অর্থ ভাতারকে খেয়ে ফেলা বা মেরে ফেলা। শব্দগুলো গ্রামবাংলায় কমবেশি প্রচলিত থাকলেও এখন অনেক আধুনিক অভিধানে অশ্লীল গণ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে বলেন, ‘ভাত’ শব্দের উৎস বিশ্লেষণে সংস্কৃত ‘ভক্ত’ ও প্রাকৃত ‘ভত্ত’ শব্দের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ‘ভক্ত’ থেকে ‘ভত্ত’ এবং সেখান থেকে ‘ভাত’ শব্দটি প্রসূত হয়েছে। প্রমাণস্বরূপ একটি প্রাচীন কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া যায় : ‘ওগ্গর ভত্তা, রম্ভম পত্তা . . . দিজ্জই কন্তা, খা পুনবন্তা। তবে ‘ভত্ত’ শব্দ থেকে ‘ভাত’ শব্দের উৎপত্তি হলেও পরবর্তীকালে শব্দটি ‘ভ’ শব্দ পরিবার থেকে দল পরিবর্তন করে ‘ভা’ শব্দ পরিবারে চলে এসেছে। যে ‘ওগ্গর ভত্তা’ বাংলাভাষীকে তার ক্ষুধার পরম প্রাপ্যরূপে প্রতিভাত করে, তাকে সে ভাতরূপেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকবে। সে ‘ভাত’-এর আধারই তার কাছে ‘ভাতা’ এবং যে সত্তা এ ‘ভাত’ সরবরাহ করার মূল ব্যক্তি সে ‘ভাতার’।

আবার উল্টোভাবে বলা যায়, ভাতার যা দেয় তা-ই ‘ভাত’। প্রাচীন বাংলায় বর্তমান ‘ভাত’রূপে প্রচলিত খাদ্যটিই ছিল জীবন-ধারণের অন্যতম আধার। পরিবারের প্রধান হিসেবে ভাতারই এটি সংগ্রহ ও প্রদানের মূল হোতা ছিল। পারিবারিক সকল সম্পর্ক, বিবাহ, কন্যার ভাতার নির্বাচন প্রভৃতি ‘ভাত’ দিতে পারা বা না-পারার সামর্থ্য দিয়ে বিবেচনা করা হত। তাই অনেকে মনে করেন ‘ভাতার’ থেকে ‘ভাত’। তবে অধিকাংশ ভাষা বিজ্ঞানীর অভিমত, ‘ভক্ত’ থেকে ‘ভত্ত’ এবং সেখানে থেকেই ‘ভাত’।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন