আমি মারের সাগর পাড়ি দেব / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

আমি মারের সাগর পাড়ি দেব :

শরীফ উদ্দিন প্রশ্ন করেছেন : "আমি মারের সাগর পাড়ি দেবো ... " এটা কোন সাগর কেউ বলবেন কি ?

খুরশেদ আহমেদ : এখানে ‘মারের সাগর’ বলতে আমি বুঝি একটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর যা পাড়ি দেওয়া জীবনযুদ্ধের সাথে তুলনীয়।

শরীফ উদ্দিন : নামটা এলো কোত্থেকে বা কি করে ? আজ প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে Del Mar ( San Diego, CA)পার হয়ে যেতে যেতে এই কথাটা মনে এল। 'মার" শব্দটার আক্ষরিক মানেও হচ্ছে সাগর।

খুরশেদ আহমেদ : "'মার" শব্দটার আক্ষরিক মানেও হচ্ছে সাগর।

হাজী রফিক : ইটালিয়ানো'তে 'মার' বলে সাগরকে। অনেক বাঙ্গালিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছি যে ওরা 'মারে' তীরে দোকানদারি করে। সিজন শেষে শহরে চলে আসে। গুরুদেবের সাথে মুসোলিনির সুসম্পর্কের কথা জানা যায়। ডিটেইল লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ 'মধ্যাহ্ন' উপন্যাসে। মুসোলিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠায় গুরুদেবকে অনেক দাক্ষিণ্য দিয়েছেন। গুরুদেব বিনিময়ে প্রশস্তি করেছেন তার; এমনকি 'দার্শনিক রাজা'র অবয়ব দেখেছেন তার মাঝে। মুসোলিনিকে খুশি করতে গিয়ে গুরুদেব একটি বাংলা গানে এই ইটালিয়ানো শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলে আমার মনে হয়। তবে 'মারের সাগর' বলা আর 'বিদেশী ফরেনার' বলা একি কথা।

জিকরুর রেজা খানম : জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে কবিগুরুকে যেতে হয়েছে এবং অনেক প্রিয়জনের মৃত্যুর বেদনা তাকে বহন করতে হয়েছে, একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন। সেই জীবনসমুদ্রই মারের সাগর, যে বার বার তাকে মরণসম দুঃখ দিয়েছে, তাকেই তিনি জয় করতে চেয়েছেন।

শুবাচ : ‘মারের সাগর’ নিয়ে অনেক আলোচনা হল। অনেকে ‘মারের’ শব্দটিকে বিদেশ পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। আবার অনেকে বলেছেন ‘মার শব্দের আক্ষরিক অর্থ সাগর’। এ প্রসঙ্গে কবিগুরুকে নিয়ে হাজী রফিকের মুসোলিনি সংক্রান্ত মন্তব্য যেমন ভিত্তিহীন তেমন হাস্যকর ও অবাঞ্চিত। এরূপ অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করার পূর্বে সবার আরও সতর্কতা প্রয়োজন। ‘ডেল মার থেকে ‘মার’ এটাও যথার্থ নয়। এমন মন্তব্য না-জেনে আন্দাজে ঢিল মারার ন্যায় বিপজ্জনক। কোন বিদেশি শব্দের উচ্চারণের সঙ্গে বাংলা শব্দের উচ্চারণের অভিন্নতা মানে অর্থেরও অভিন্নতা - এটি ঠিক নয়।

‘মারের সাগর’ নিয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যাসমূহের মধ্যে খুরশেদ আহমদ আহমদ ও জিকরুর রেজা খানমের ব্যাখ্যা যথার্থ এবং নিঃসন্দেহে চমৎকার ও গ্রহণযোগ্য। উভয়ে বলেছেন, ‘মারের সাগর’ বলতে কবি এমন একটি স্থান/সাগর/প্রান্তর বুঝিয়েছেন যেটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এবং যা পাড়ি দেওয়া জীবনযুদ্ধের ন্যায় কষ্টকর।’ এটিই শব্দটির আসল অর্থ। ‘মার’ বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত সহজ ও বহুমাত্রিক অর্থদ্যোতক একটি শব্দ। যে কোন সাধারণ অভিধানেও এর অর্থসমূহ দেওয়া আছে। ‘মার’ শব্দের সঙ্গে ষষ্ঠী বিভক্তি ‘র/এর’ যুক্ত হয়ে ‘মারের’ শব্দটির উৎপত্তি। এটি কোন বিদেশি শব্দ নয়। ‘মার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘সাগর’ও নয়। তা হলে ‘মারের সাগর’ অর্থ হয়ে যায় ‘সাগর সাগর’।

এবার ‘মার/মরের’ শব্দের অর্থ কী দেখা যাক। মার (মারণ, মারা); মার = মর- হতে জাত। মারণ = মার (অন) যাহাতে। মারের = মার +এর। মারা = মার এর আধার যে। মার = বিরহীকে মারে যে(বিরহীমারক)। কলিম খান ও রবিচক্রবর্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে সুস্পষ্টভাবে মার (মারের) অর্থ দেওয়া হয়েছে। মার = মারক, বিনাশক, ঘাতক, মারণ, তাড়ন, কাম, মৃত্য ... ইত্যাদি; প্রহার, আঘাত, বিনাশ, শাসন, .., বিনাশ করা, বধ করা,, প্রহার করা ইত্যাদি। ‘মারের সাগর’ মানে দুঃখময় সংসার, ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগর, ভয়ঙ্কর সাগর, কষ্টময় জীবন। এখানে ‘মারের’ অর্থ শুধু সাগর নয়; মানুষকে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়, অনেক বিরহ, ব্যাথা, প্রিয়জনের মৃত্যু, বঞ্চনা ও বেদনা বহন করতে হয়। এ জীবনযুদ্ধই হচ্ছে ‘মার’ এবং মারের সাগর হচ্ছে এমন সংগ্রামমুখর সাগর।

Comments

  1. বৌদ্ধ কাহিনীতে আছে বোধিলাভের আগে অপদেবতা মার তপস্যারত সিদ্ধার্থকে অনেক ভয় ও লোভ দেখিয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধ কাহিনী ও দর্শন খুব গভীরভাবে জানতেন। আমার অনুমান এখানে মার হলো সেই অপদেবতা। বৃহত্তর অর্থে দুঃখময় জীবন সমুদ্র তো বটেই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন