রবীন্দ্রালো / তাসমিনা হোসেন- শুবাচ

 রবীন্দ্রালো

"ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই। " অনেক আপনজনের মৃত্যুর সাক্ষী রবীন্দ্রনাথের মত মহান মানুষ প্রকৃতির নিয়মকে এভাবেই স্বাগত জানায়। আমার বয়স বাড়ার সাথে রবীন্দ্রনাথকে ভিন্ন আঙ্গিকে জানছি। আর যতই জানছি, ততই এক দুর্নিবার আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আরও অনেক কবিই রবীন্দ্রনাথের গানকে দুর্বল রচনা বলেছেন। সাহিত্যমুল্য আমি বুঝি না। আমার অনেক কষ্টে এই গান আমায় আশ্রয় দেয়। আমার ভেতরে চেপে থাকা অনেক কষ্ট এই গানের সাথে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে! অনেক বিপদেও আমাকে সাহস দেয়। যদিও আমার ভানুর মত আমি নির্ভীক চিত্তে বলতে পারি না "বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদে আমি না যেন করি ভয়। " অসুস্থ কন্যা রেনুকাকে রোজ দু'বেলা কবিতা পড়ে শোনানো, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মেয়েকে উৎসর্গ করে 'শিশু' রচনা করা এ বুঝি তাঁর মত বড় মানুষেরই সাজে। কত অপমান সহ্য করেছেন কন্যা জামাতা শরৎ বসুর কাছে। অথচ শরৎ বসু ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় ও দুটি বিষয়ে অনার্সে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম। মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে বিশ হাজার টাকার যৌতুক দিতে তিনি রাজী হয়েছিলেন। পরে দর কষাকষিতে পণ পনের হাজার টাকা করা হয়। তাও তিনি দশ হাজার টাকা মাত্র শোধ করতে পেরেছিলেন। পরে দুই হাজার টাকা দেন। অথচ নোবেল পুরষ্কারের টাকার অর্ধেক তিনি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যয় করেন। স্ত্রীর গয়না বিক্রি করেন শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পেছনে। আজ যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, সেই ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাও তিনি বহু আগেই করে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ে মাধুরীলতা যখন অসুস্থ, রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন দুবেলা যেতেন মেয়েকে সময় দিতে। ভাবতেন, মেয়ের শেষ সময় আনন্দে ভরে দিবেন। কিন্তু তাঁর এই স্বনামধন্য জামাতা রোজ তাঁর মুখের সামনে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে সিগারেট টানতেন! পিতা রবীন্দ্রনাথ রোজ পিতৃবাৎসল্যের মাশুল দিতেন। মেয়ের মৃত্যুর পর তিনি এই নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পান । ছোট মেয়ে মীরার সংসার জীবনও সুখের হয়নি। ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ যেদিন মারা গেলো ,তিনি ট্রেনে করে যাচ্ছেন খবর পেয়ে। চারদিক জোৎস্নায় ভিজে যাচ্ছে। তিনি তাঁর স্মৃতি কথাতে লিখেছেন ,"শমীন্দ্রনাথ যেদিন মারা গেলো ,জোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে। কোথায় কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বলে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সব রয়ে গেছে। আমিও তার মধ্যে। " জীবনের আসা -যাওয়া প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার নিমিত্তে, এমন নিস্পৃহভাবে কে আর ভাবতে পেরেছেন! শমীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর প্রিয় পুত্র। ছোট ছেলে শমীর আত্মার সাথে প্ল্যানচেট করে দিনের পর দিন কথা বলেছেন। একি তাঁর শুধুই আধি ভৌতিকে বিশ্বাস না পিতৃ হৃদয়ের অব্যক্ত যন্ত্রনা ! আর তাই হয়তো তিনি বলেছেন, "আরো আরো প্রভু, আরো আরো
এমনি ক'রে আমায় মারো।।
যা কিছু সব কাড়ো কাড়ো
দেখি কেমন কাঁদাতে পারো।। "
শোককে তিনি শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। আর তাই তাঁর খেলার সাথী নতুন বৌঠান, ছুটি তাঁর ছেলে -মেয়ে ,তাঁর প্রিয় নাতি প্রত্যেকের মৃত্যু তাঁর কাছে এক একটি চেতনা হয়ে এসেছে।
" আরো বেদনা আরো বেদনা
প্রভু দাও মোরে আরো চেতনা। "
আর তাই হয়তো আমার বেদনার ভেতর রবীন্দ্রনাথের কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কবি সুফিয়া কামাল একবার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করলে নাকি তাঁর মনে হয় সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনি প্রার্থনা করছেন। রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের কবিতাগুলো সৃষ্টিকর্তার প্রতিই নিবেদিত হয়েছে। কত সুন্দর করে তিনি বলতে পারেন -
"সীমার মাঝে অসীম তুমি
বাজাও আপন সুর
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এতো মধুর। "
সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মাঝেই তাঁর সাফল্য। তাঁর এই লেখাগুলো পড়াও যেন একার্থে প্রার্থনা করা।
মাত্র ষোল বছর বয়সে কি করে লিখেছেন, ' মরণ রে , তুঁ হুঁ মম শ্যাম সমান। ' ভানুসিংহের পদাবলী তাঁর ষোল বছরের রচনা।
রবীন্দ্রনাথ আমার প্রাণের রবীন্দ্রনাথ আমার বাংলাদেশের সাথে মিশে রয়েছেন। লালনকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করাতে তাঁর মত মানুষই পারেন। কোন মানুষকে তিনি ছোট করেননি। তাঁর সবসময় চিন্তা ছিল এই বাংলাকে ঘিরে। পেছানো বাংলা সাহিত্যকে তিনি একা টেনে তুলেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রকৃতি তাঁকে কাজ করতে এই বিশ্বলোকে এনেছে। আর তাই শত বাধা -বিঘ্নের মাঝেও তিনি তাঁর কলম চালিয়ে গেছেন।
প্রকৃতিকে অনেক সুন্দর করে দেখার দিব্য দৃষ্টি তাঁরই দেয়া! জীবন যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, নিজের জন্মকে মনে হয় বৃথা তখন তাঁর গানেই পাই এই মহাবিশ্বে আমার অপরিহার্যতা। " আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব - ভরা প্রাণ / তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি / আমি পেয়েছি মোর স্থান / বিস্ময়ে তাই জাগে /জাগে আমার প্রাণ.। " রবির সাথে চলে আমার জানার মাঝে অজানাকে সন্ধান!
আমার প্রতিটি দিনেই আছে রবীন্দ্রনাথ। যেখানেই শুনি আমার সোনার বাংলা, সেখানেই. আমার রবীন্দ্রনাথ, আমার গগন হরকরা। রবীন্দ্রনাথ যে লালন ,গগন হরকরাকেও বুকে ঠাঁই দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন নতুনভাবে জন্ম নিচ্ছেন আমার ভেতর। প্রতিদিন তাঁকে নতুনভাবে উন্মোচনের আনন্দ !
শুভজন্মদিন বিশ্ব কবি।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন