মাসুদ আহমেদ : বাংলা ছোটগল্প ও উপন্যাসের নিলয় মাধুর্য / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

মাসুদ আহমেদ : বাংলা ছোটগল্প ও উপন্যাসের নিলয় মাধুর্য


বিসিএস (অডিট এন্ড অ্যাকাউন্টস) ক্যাডারের সদস্য বিপুল সম্ভারে ঋদ্ধ বৈচিত্র্যময় সৃজনশীলতায় ভাস্বর অনুপম মেধার অধিকারী কথাসাহিত্যিক মাসুদ আহমেদ জামালপুর জেলার সরিষাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এম এ ওয়াহিদ কেন্দ্রীয় শুল্ক ও আবগারী বিভাগের পরিদর্শক ছিলেন। মায়ের নাম বেগম রাজিয়া ওয়াহেদ। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলার ধামরাই থানায়। তাঁর পিতা-মাতা উভয়ে ছিলেন মননশীল মেধা ও আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী উদার অথচ ধর্মপ্রাণ। পিতার চাকরিসূত্রে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর অধ্যয়নের সুযোগ ঘটে। এটি তার জীবন, দর্শন, চিন্তা-চেতনা ও অভিজ্ঞতাকে বহুমুখী মিথষ্ক্রিয়ায় পরিশীলত করে তোলে। জনাব মাসুদ আহমেদ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। আনুষ্ঠানিক অধ্যয়ন শেষে ১৯৮১ ব্যাচে সিভিল সার্ভিস (অডিট ও অ্যাকাউন্টস) ক্যাডারে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী রিফাত রেজা বনানী বিদ্যানিকেতনে শিক্ষকতা করেন।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য পদে থাকাকালীন তিনি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ১১তম কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল (মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক) পদে নিয়োগ লাভ করেন। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করান। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলির পূর্বে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন।

মাসুদ আহমেদ সাহিত্যের ছাত্র, সংগতকারণে সাহিত্য তাঁর অমিয় অনুভূতির প্রকাশ হিসেবে লালিত্য অস্থিমজ্জার অংশ। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি সাহিত্যচর্চায় জড়িত। একজন মানুষের অনুভবনীয় প্রজ্ঞায় সাহিত্য ও সৃজনশীল কর্মপ্রবরণার যে সকল উপাদান আবশ্যক তার সবগুলো কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও কাব্যময় ছোটগাল্পিক মাসুদ আহমেদে পূর্ণ ঋদ্ধতায় বর্তমান। ছোটগল্প, উপন্যাস ও সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর স্বকীয় চেতনায় ঋদ্ধ মেধা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। তাঁর লেখা পড়লে পাঠকমাত্র একটা মোহময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারেন, সেটি হচ্ছে তিনি কী সাহিত্যের অংশ না কি সাহিত্যই তার অংশ। বাস্তবতা তাঁর কল্পনাকে ছুঁয়ে আরও বাস্তব হয়ে উঠে। তাই ছোট ছোট ঘটনাগুলো হয়ে যায় বিশাল। উদাহরণস্বরূপ তার অনবদ্য ছোটগল্প ‘পিতা ও পিতৃব্য’-এর কথা বলা যায়। কি হৃদয় বিদারক নিপুণতার সঙ্গে এঁকেছেন প্রাত্যহিক ঘঁনার ঘণঘটা। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি মাসুদ আহমেদের সাহিত্যকর্মের মূল বিচরণ ক্ষেত্র হলেও সাহিত্যের প্রত্যেকটি অঙ্গনে তাঁর অনুপম মেধার নিখুঁত প্রাঞ্জলতা সতত দেদীপ্যমান। মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, বাঙালির জাতিগত বৈশিষ্ট্য, আর্থ-সামাজিক টানাপোড়ন, জনসংখ্যাধিক্য ও পরিবেশ এবং এই অধিবাসের ভবিষ্যৎ চিত্রকল্প মাসুদ আহমেদের লেখার বিষয়বস্তু। অধিকন্তু তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনবোধের যে নিগূঢ় তথ্য বাস্তব মাদকতায় উঠে আসে তা যেমন অকৃত্রিম তেমনি উৎকর্ষ মাধুরিমায় নিত্য সচল পরিমত্ততা।

২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ছোট গল্প সংকলন ‘আহির ভাঁয়রো’ প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর সুর্যোজ্জ¦ল আবির্ভাব। গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের জগতে একটি নতুন ধারণার সূচনা ঘটান। এ নতুন ধারণাটি হচ্ছে কল্পনাকে অনুভূতির সুক্ষ্ম নান্দনিকতার আলোকে বাস্তব পরিম-লে তুলতুল সৌকর্ষে স্বকীয় ভাবনায় সর্বজনীন করে তুলতে পারার অনিমেষ দক্ষতা। ছোটগল্প হলেও গ্রন্থটির প্রতিটি বাক্য কাব্যপ্রাবল্যে উদ্ভাসিত এক একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। এ পর্যন্ত তিনি ১১২টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। প্রতিটি ছোটগল্পে তিনি যেন নতুন। ১১২টি ছোটগল্পে মাসুদ আহমেদ নিজেকে অসংখ্য বিবর্ধনে আপ্লুত করেছেন সহস্র অভিধায়। এর চেয়ে ছোটগল্পের বড় সার্থকতা আর কী হতে পারে!

উপন্যাসে তিনি নতুন আঙ্গিকে বিবর্তিত আর এক নিলয় মাধুর্য। ছোটগল্পের মতো এখানেও তার সরব পদচারণায় একটি আলাদ ঐতিহ্য আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে প্রাকৃতিক পরিবর্তনশীলতার মতো হৃদয়গ্রাহী বিমূর্ততায় বিলকুল আকুল-ব্যাকুল। ‘চৈত্রপবন ও দিগন্তরেখা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এখানে তিনি জীবনকে প্রতিটি প্রয়োজনীয় সূত্রের সঙ্গে সরল সমীকরণে প্রমুগ্ধ অবলীলায় চূড়ান্তে নিয়ে গেছেন আকর্ষণের পিনপতন প্রাবল্যে। জীবনের ছোটখাটো বিষয়কে অসাধারণ কুশীলবতা তুলে ধরার সপ্রাণ আন্তরিকতা তার উপন্যাসগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রতি বাকে, অনুচ্ছেদে, কথোপকথনের পরতে পরতে নির্ঝর প্রকৃতির কলহাস্য উপন্যাসকে জীবনের জীবনে টেনে নিয়ে আসে। স্বপ্নযাত্রা উপন্যাসে তিনি উপমহাদেশের ইতিহাসে উন্মাতাল ১৯৪৭ এর রাজনীতিক ঘঁনাবলীর পটভূমিতে অপূর্ব ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। এতে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম বোধ ও শ্বাশত চেতনার সঙ্গে ইংরেজ শাসকদের নির্মম চাতুর্য, সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপট সার্বিক ঘঁনার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াসহ সুললিত ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি ৭টি উপন্যাস রচনা করেছেন। প্রতিটি উপন্যাসে পাঠক তাকে আবিষ্কার করেন নিজের অন্তরের বিমুগ্ধ মোহময়তায়। ইতোমধ্যে তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে ৮টি কাহিনীভিত্তিক নাটক ও টেলিফিল্ম হয়েছে।


মাসুদ আহমেদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে আহির ভাঁয়রো, ২০০৫, ছোট গল্প সংকলন; শিল্পী ও কলোরাডো, ২০০৬, ছোট গল্প সংকলন; গৌরি ও একুশ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ, ২০০৬, ছোট গল্প সংকলন; নীল শালুকের ঝিলে, ছোট গল্প সংকলন; চৈত্রপবন ও দিগন্তরেখা, ২০০৭, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস, স্বপ্নযাত্রা, ২০০৮, ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস; কামা, ২০০৮, ছোটগল্প সংকলন; বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাস, ২০০৮, গবেষণা প্রবন্ধ; মেঘ আছে জল নেই, ২০০৯, ছোট গল্প সংকলন; বুজির নীলিমা, ২০০৯, আঙিনায় জোৎস্নাতে, ২০১০, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস; লতা মঙ্গেশকর, বাংলা একাডেমী পত্রিকা, ২০১০, গবেষণা প্রবন্ধ; চাঁদ যখন উঠলো, ২০১১, উপন্যাস; অন্যজন, ২০১১, ছোট গল্প সংকলন; নীতি শিক্ষা, শিশু এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহ, ২০১২, প্রবন্ধ সংকলন; বিপ্রতীপ, ২০১২, উপন্যাস; ভাইফোঁটা, ২০১২, ছোটগল্প সংকলন; লেডী টিচার দিচ্ছি / নিচ্ছি, ২০১৩, ছোটগল্প সংকলন; কোথায় পাব তারে, ২০১৩, উপন্যাস এবং ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

তাঁর গ্রন্থের মধ্যে ‘ভাইফোঁটা’, ‘অন্যজন’, ‘ধাহির ভাঁয়রো’, ‘নীল শালুকের ঝিলে’ এবং ‘ চৈত্রপবন ও দিগন্ত রেখা’ বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উঁংশ উধহি ধহফ ষরনবৎধঃরড়হ’ প্রকাশিত হয়। এ অনবদ্য উপন্যাসটি মার্কিন যুক্তরাজ্যের অঁঃযড়ৎ ঐড়ঁংব থেকে প্রকাশিত হয়। ‘আহির ভাঁয়রো’ বইটির জন্য তিনি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতি সংস্থা নাট্যসভার শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিসেবী পুরস্কার অর্জন করেন। একই গ্রন্থের জন্য তিনি সংস্কৃতি সংস্থা ‘সৃজন’-এর বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। এয়াড়াও তিনি সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য নানা পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।

শধু লেখক হিসেবে নয়, কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও মাসুদ আহমেদ বর্ণীল মেধার অনাবিল তৃপ্তি। কণ্ঠে তার যাদু নয়, নিবিষ্ট প্রেমের সুরবন্ধন। এখানে হৃদয় কণ্ঠ-উর্মীর ঢেউয়ে শুধু নাচে না, নাচায়ও। সোনালি যুগের বাংলা গানের একজন মেধাবী কিন্তু অপেশাদার কল্কশিল্পী হিসেবে তাঁর বোদ্ধামনে সারল্যের লয় লয়হীন প্রহরে বিলীন হয়ে যায় অসীমে। তিনি মৃদঙ্গ ‘সৃজন’ ও ‘সিটাডেল’- এর সদস্য ও নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী। কণ্ঠশিল্পে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি পুরস্কার পেয়েছেন।

বর্তমানে তিনি মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক পদে কর্মরত আছেন। এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও সাহিত্যকর্মে এমন একনিষ্ঠ একাগ্রতা সত্যি অনবদ্য।


Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন