ঠাণ্ডা ও গণ্ডগোল / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ

ঠাণ্ডা তৎসম শব্দ নয়। তবে গণ্ডগোল নিয়ে গণ্ডগোল আছে। গণ্ডগোলের গণ্ড তৎসম: {স. গম্‌+ড}; গোল ফারসি: {ফা. গল ﻏﻝ },

ট-বর্গের ট ঠ ড ঢ - এই চারটি বর্ণের পূর্বে যদি ন্ ধ্বনি থাকে এবং ঐ ‘ন্’ সহযোগে যদি যুক্তবর্ণ তৈরি হয়, তা হলে তা সর্বদা মুর্ধন্য-ণ হবে। যেমন : কণ্টক, ঘণ্টা, কণ্ঠ, ঠাণ্ডা, দণ্ড ঢুণ্ঢন ইত্যাদি। ( সূত্র : ড. হায়াৎ মামুদ রচিত ‘বাংলা লেখার নিময় কানুন’ ; পৃষ্ঠা ৪২ )। সেই অনুযায়ী ‘ঠাণ্ডা’ ও ‘গণ্ডগোল’ শুদ্ধ। “ বিদেশী শব্দে nt/nd থাকলে ণ্ট/ণ্ড হওয়াই উচিত; যেমন ওণ্টারিও, প্যাণ্ট, ব্যাণ্ড, লণ্ডন। কারণ ন+ট/ন+ড সংবলিত কোনো শব্দ বাংলা ভাষায় নেই, তাই এ-জাতীয় কোনো যুক্তবর্ণও বাংলা লিপিতে নেই। ফলে nt/nd লিপ্যন্তরে ন্ট/ন্ড অবশ্যই ভুল হবে; কিন্তু যুক্তবর্ণ দিয়ে না-লিখে ভেঙে লিখলে ভুল হবে না, যেমন ওন্‌টারিও, প্যান্‌ট, ব্যান্‌ড, লন্‌ডন্ ইত্যাদি। ” ( সূত্র : ড. হায়াৎ মামুদ রচিত ‘বাংলা লেখার নিময় কানুন’ ; পৃষ্ঠা ৩৮ )। সেই হিসেবে আমার মনে হয় প্যাণ্ট, ইণ্ডাস্ট্রি, বাসস্ট্যাণ্ড ইত্যাদি লিখলে ভুল হবে না।

দুটি নিয়ম যেখানে, সেখানেই সব বিভ্রান্তি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত বিদেশি শব্দে ণ এবং ষ বর্জন করা উচিত। এগুলো কেবল সংস্কৃত ভাষাতেই পাওয়া যায়। ট, ঠ, ড এর আগে ণ হবে, এটাও সেই ভাষার নিয়ম, বাংলার নিয়ম নয়। " ন+ট/ন+ড সংবলিত কোন শব্দ বাংলা ভাষায় নেই, তাই এ-জাতীয় কোন যুক্তবর্ণও বাংলা লিপিতে নেই। ফলে nt/nd লিপ্যন্তরে ন্ট/ন্ড অবশ্যই ভুল হবে; কিন্তু যুক্তবর্ণ দিয়ে না-লিখে ভেঙে লিখলে ভুল হবে না, যেমন ওন্‌টারিও, প্যান্‌ট, ব্যান্‌ড, লন্‌ডন্ ইত্যাদি।" এক্ষেত্রে বলা দরকার বিদেশি শব্দ লেখার জন্য আমরা অনেক নতুন যুক্তবর্ণ বানিয়ে নিয়েছি যা বাংলা লিপিতে ছিল না, যেমন ফিল্ড, স্ক্লেরেনকাইমা, স্প্রে, এক্সট্রা, অক্টোপাস ইত্যাদি। যদি এই যুক্তবর্ণগুলো মেনে নিই তাহলে ন্ট আর ন্ড মেনে নিতে অসুবিধা থাকার কথা নয়।

এ প্রসঙ্গে ড. মাহবুবুল হক রচিত ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ (অষ্টম মুদ্রণ : জানুয়ারী২০১৪) বই এর ৮৯ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়- “ [ বিদেশি শব্দে ট/ড/- এর আগে দন্ত্য-ন ] যেমন এজেন্ট, কম্পাউন্ডার, পেটেন্ট, ফ্রন্ট, বান্ডিল, প্যান্ডেল, সেকেন্ড, ওয়ারেন্ট, প্যান্ট, ফান্ড, বন্ড, সার্জেন্ট, হ্যান্ডেল।“ বাংলা একাডেমি সম্প্রতি এই নিয়মে বিদেশি শব্দগুলোতে দন্ত্য-ন এর ব্যবহার প্রমিত হিসেবে গণ্য করেছে। সেই হিসেবে বর্তমানে প্রমিত বানানগুলোকে আমাদের গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই। বিধায় প্যাণ্ট, ইণ্ডাস্ট্রি, বাসস্ট্যাণ্ড ইত্যাদি লিখলে ভুল না হলেও প্রমিত হিসেবে আমরা প্যান্ট, ইন্ডাস্ট্রি, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি লিখতে পারি।

বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২.০৩. বলছে: “তৎসম শব্দের বানানে ণ, ন-য়ের নিয়ম ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে৷ এ-ছাড়া তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র কোনো শব্দের বানানে ণত্ব-বিধি মানা হবে না অর্থাৎ ণ ব্যবহার করা হবে না৷ … তৎসম ছাড়া অন্য সকল শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগেও কেবল ন হবে।” একই দলিলে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ৪.০১. ণত্ব-বিধি সম্পর্কে দুই মত প্রকাশ করে বলেছে: “অ-তৎসম শব্দে যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেন নি। একটি মতে … এসব শব্দে যুক্তাক্ষরে ণ্ট ণ্ঠ ণ্ড ণ্ঢ হবে। যথা : ঘণ্টা, লণ্ঠন, গুণ্ডা। অন্যমতে … এসব শব্দের যুক্তাক্ষরে ন্ট ন্ঠ ন্ড ন্ঢ ব্যবহৃত হবে। যথা : ঘন্টা, প্যান্ট, প্রেসিডেন্ট, লন্ঠন, গুন্ডা, পান্ডা, ব্যান্ড, লন্ডভন্ড।

যেখানে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২.০৩. অত্যন্ত স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, ভুল বোঝাবুঝির অবকাশহীন, সেখানে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ৪.০১. প্রথমোক্ত নিয়মটিকে লঘু ও জলো করে দিল। নিয়ম ৪.০১.-এর আশ্রয়ে আপনি চাইলে অপবাদ ও শাস্তির আশঙ্কা ছাড়াই নিয়ম ২.০৩. অগ্রাহ্য করতে পারেন, ভাঙ্গতে পারেন।

যুক্তভাবে নিয়ম ২.০৩. ও ৪.০১.-এর ফল হলো এই যে, ঠান্ডা বা ঠাণ্ডা শব্দটি তৎসম শব্দ বলে কেউ দাবি না করলেও, ঠান্ডা ও ঠাণ্ডা বানানে শব্দটি যেমনভাবে-খুশি লেখায় আমরা এখন একটি অস্থিরতার ও অরাজকতার মধ্যে বাস করছি। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান বাংলা একাডেমিরই প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২.০৩.–কে অগ্রাহ্য করে বানান লিখেছে: ঠাণ্ডা; অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির আকাদেমি বানান অভিধান (২০১১) একই শব্দের বানান লিখছে: ঠান্ডা।

নিয়ম ৪.০১. অনুযায়ী আপনি চাইলে ঠাণ্ডা লিখতে পারেন, আবার যদি চান ঠান্ডাও লিখতে পারেন; বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম আপনি ভঙ্গ করেছেন আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেউ করতে পারবে না! অ-তৎসম শব্দে যুক্তাক্ষরের বানানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ একমত হতে পারেননি – এ সমস্যাটি শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের নয়, সমস্যাটি কমিটির পণ্ডিত সদস্যদের।
অতএব ঠাণ্ডা বানানে ড এর সঙ্গে দন্ত্য-ন বা মূর্ধন্য-ণ দুটোই ব্যবহার করতে পারেন।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

হিসাব আর হিসেবে / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ