গানের প্রাণ : ভুঁইয়া সফিকুল ইসলাম / ড. মোহাম্মদ আমীন



গানের প্রাণ

গান যদি প্রাণ, সুর যদি নিগুঢ় এবং ছন্দ যদি অনিন্দ্য না হয় তো সে গান প্রাণহীন লাশ। তাই গানকে বলা হয় সৃষ্টির মূল। এ গান হতে শব্দ, শব্দ হতে অক্ষর, অক্ষর হতে জ্ঞান। তাই জ্ঞান আর গান পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। যে গানে জীবনকথা নেই সেটি গান নয়, অজ্ঞান। চিরায়ত বাংলা গানে আমাদের এমন অভিজ্ঞতাই দিয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান গীতিকবিতা ও চিরায়ত সঙ্গীত ভূবনে খ্যাতিমান প্রশাসক ও কবি ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম এক নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধার প্রতি নিবেদিত ‘বাঙালি জাতির সেরা গর্ব’, দেশপ্রেমের মুগ্ধতায় আপ্লুত ‘হে দেশ আমার গর্ব’, ‘একুশ তুমি’, ‘ভাষার প্রেম কাতর’ ও সাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জের ঘটনা নিয়ে চয়িত ‘জাগো নারায়ণগঞ্জবাসী’সহ প্রত্যেকটা সিডি সংগীত বোদ্ধাগণের মনে তুলে নিপুণ ঝড়, বিপুল স্বর আর বিমুগ্ধ প্রহর। অত্যাধুনিক যান্ত্রিক জগতে বর্তমান প্রজন্ম যখন চটুল গান ও ক্ষণস্থায়ী অপসংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে, সে সময় ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম চিরায়ত বাংলা গানের ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্যকে আবার সবার সামনে তুলে ধরেছেন অনবদ্য দক্ষতার জাদুময় স্মারকে। তিনি বর্তমানে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব। সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিবেদিত থেকেও সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর সরব পদচারণা বিস্ময়কর। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, গবেষক, গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও বক্তা। বর্ণিত প্রতিটি ক্ষেত্রে তার রয়েছে স্বকীয় বোধ। যা ইতোমধ্যে তাঁকে স্বমহিমায় ভাস্বর করে তুলেছেন বোদ্ধামহলে।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার দারিয়ালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আলী ভূঁইয়া ও মায়ের নাম রমিছা বেগম। খুলনা বি এল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর  ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিকালীন তিনি যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থশাস্ত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইন ডেভেলাপমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রিও অর্জন করেন। সৎ, অমায়িক ও মননশীল চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক মূলবোধে বজ্রকঠোর মমতায় ঋদ্ধ জনাব ভূঁইয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে দক্ষতা ও কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে প্রভূত সুনামের অধিকারী হয়েছেন। তিনি পাট অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম মূলত কবি। তবে কবিতা আর গান যে কত নিবিড়, কত আপন এবং পরিপূরক-সম্পূরক তা কবির সংগীত জগতের জটিল পথে সুদক্ষ পদচারণার স্বতস্ফূর্ত অবলীলা তা-ই প্রমাণ করে দেয়। ইতোমধ্যে তাঁর ১৩টি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। তম্মধ্যে ১. হৃদয়ে প্যালেস্টাইন, ২. বিপন্ন অর্জুন , ৩. নির্বাচিত কবিতা [ইংরেজিতে অনূদিত], ৪. নীলপদ্ম ও পাথরের কবিতা (২০১০), ৫. বাণী বনের ফুলদল (২০১১), ৬. ওই রেখা তুমিই পেরোবে (২০১১), ৭. নন্দনবনবাণী (২০১২), ৮. উদ্যানর আড়াল থেকে (২০১২), ৯. তবু আছে তারা ও জোনাকি (২০১৩), ১০. সমিল শব্দের তীর এবং ১১. ডুবেছে অমৃত সূর্য (২০১৪)  বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংখ্যার দিক থেকে তেমন বেশি না-হলেও কাব্যগুণ বিবেচনায় ভূইয়া সফিকুল ইসলাম বাংলা কাব্যে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন - এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কবিতায় তিনি শুধু কবি নন, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর মানবতার প্রতিভূ। তুলনাহীন বাক্য বিন্যাস আর হৃদয়গ্রাহী বিষয় বরাতে আধুনিক কাব্য জগতে তিনি নিজস্ব ঢঙে সৃষ্টি করেছেন এক নতুন প্রান্তর, বিস্ময়কর দিগন্ত। এ দিগন্ত অসীম কোড়কে সীমাহীন লাবণ্যের প্রজ্ঞাময় স্নিগ্ধতা।  শুধু কবিতা কেন, প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবেও তার সাবলীল পদচারণা রয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে বর্তমান বাংলা সাহিত্যে তিনি অসামান্য কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ : আশ্রয়ের ছায়াতল’ রবীন্দ্র ভাবনায় সৃষ্টি করেছে এক নতুন প্রান্তর। যেখানে প্রেম, কষ্ট, ঘৃণা, দুঃখ, জীবন-মরণ, জ্বরা-বিঘ্ন সবকিছু মধুর মাধুরিমায় গ্রহণ-বরণের লীলা স্ফুরিত।

কবিতা তার সাহিত্যকর্মের প্রধান হলেও ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর এক ক্ষণজন্মা ইতিহাস। ইতিহাস শব্দটা সচেতনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর সৃষ্টি শুধু প্রকাশ নয়, অন্তরের চারপাশ ঘেঁষে বেরিয়ে আসা বাস্তবতার জলন্ত সাক্ষ্য- মূলত এটাই তো ইতিহাস। গানকেও কীভাবে ইতিহাসের মতো উপস্থাপন করা যায় তা তাঁর গানগুলো না-শুনলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু এটাই সত্য, জাগো নারায়ণগঞ্জবাসী, বাঙালি জাতির সেরা গর্ব, একুশ তুমি প্রভৃতি সিডির গানগুলো কী শুধু গান! না, শুধু গান নয়, জীবন্ত ইতিহাস। শতবর্ষ পরেও এ সিডিগুলো সংশ্লিষ্ট ঘটনাকে গানে গানে ইতিহাসের মতো তুলে ধরতে সক্ষম হবে।

আধুনিক বাংলা গানে তার অবদান অনস্বীকার্য। গীতিকার হিসেবে তার লেখা গানের সংখ্যা চারশ ছড়িয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে তাঁর লেখা গান নিয়ে দেশের বিভিন্ন খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান হতে ১৪টি সিডি প্রকাশ পেয়েছে।  তম্মধ্যে ১. নামো সন্ধ্যা ধীরে , ২. তুমি আমার শান্ত চোখের জল, ৩. তোমার স্মরণে, ৪. তোমার সুখে, ৫. আকাশ পাখিরা উড়ছে, ৬. একুশ তুমি, ৭. ওগো মেঘ আমার, ৮. ওরা ধর্মের কথা বলে, ৯. ভাষার প্রেমে কাতর আমি, ১০. হে দেশ আমার গর্ব, ১১. বাঙালি জাতির সেরা গর্ব, ১২. জাগো নারায়ণগঞ্জবাসী এবং ১৩. তোমার ছোঁয়ায় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবি ও গীতিকার হিসেবে তার সুনাম ও অবদান যেমন সুবিদিত, তেমনি তিনি প্রশংসিত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও। তাঁর লেখা অনেক গানের সুর ও কণ্ঠ স্রোতৃবৃন্দকে স্বপ্নীল বাস্তবতায় রূপোলি বিকেলের মতো অনবদ্য মুগ্ধতায় স্নিগ্ধ করে তোলে। তাঁর ভরাট কণ্ঠে যে কোনও গান ঝর্ণার মতো কলকল আর প্রকৃতির মতো লাস্য হয়ে ওঠে আগ্রহের কোলাহলে। অমায়িক দরদ তাঁর কণ্ঠের অবিচ্ছেদ্য অনুভাবনা হয়ে স্রোতাদের হৃদয়ে তোলে নিষ্পাপ তরঙ্গ।

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও আপন কৃতিত্বে অবিনশ্বর। নিজের লেখা অধিকাংশ গানে তিনি নিজেই সুর দিয়েছেন, কণ্ঠও দিয়েছেন অনেক গানে। এটি আমাদেরকে রবীন্দ্র প্রতিভার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর গানে কণ্ঠ দেওয়া অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে সুবীর নন্দী, আলম আরা মিনু, শামা, তিমির নন্দী, ফেরদৌস আরা, শারমীন সাথী ইসলাম, আলম মাহমুদ, সঞ্জয় রায়, স্বপন, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, আবু বকর সিদ্দিক, চন্দনা মজুমদার এবং ভারতের জয়ন্ত দে, তনুশ্র দত্ত ও শম্পা কুণ্ডুসহ আরও অনেক খ্যাতিমান বোদ্ধা শিল্পী রয়েছে। 

সৃষ্টি নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের কিন্তু কেউ যদি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টির লালন ও অন্যকেও সৃষ্টিকাননে সন্তরণে সহায়তার উদ্যোগ নেন তিনি নিঃসন্দেহে মহাকৃতিত্বের অধিকারী। কষ্টকর শোনালেও সত্য যে, বর্তমানে বাংলা গানের ভূবনে চিরায়ত গানের মহা দুর্দিন চলছে। বিশ্বায়নের হাওয়া আমাদের বাংলা গানের সেই চিরকালীন প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতাকে যান্ত্রিক দৈতকণ্ঠের চিৎকারে গিলে ফেলার জন্য বিভৎস কণ্ঠ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ন্যায় যেন তেড়ে আসছে। কোনও কাণ্ডারি নেই রক্ষা করার, কেউ নেই পৌরাণিক কাহিনীর আভির দস্যুদের কবল থেকে সুললিত সঙ্গীতের সঙ্গম মাধুর্যকে রক্ষা করার। অর্জুন স্তব্দ। বাংলা গানের উষ্ণ উপত্যাকা প্রেমের বদলে ধর্ষণাঘাতের বিকৃতিতে পোড়া যুবতীর দেহের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এমন  দুঃসময়ে আধুনিক বাংলা গানের কাণ্ডারি হয়ে এগিয়ে এসেছেন ভূইয়া সফিকুল ইসলাম। বাংলা গানকে ধর্ষণের অপমান হতে রক্ষা করার জন্য তিনি তাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন। এর প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম নিজি সিডি বিক্রির দশ লক্ষ টাকা সংগীত শিল্পের উন্নয়নে প্রদান করেছেন। বাংলা সংগীতের ইতিহাসে এমন উদারতা ও নিঃস্বার্থ ত্যাগ সত্যি বিরল। এমন উদারতা শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে জাতীয় যাদুঘর প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে তিনি সিডি বিক্রির ১০,০০০০০ টাকা দান করেন। ঐ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংগীত উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও বিশেষ অতিথি ছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী জনাব আবুল কালাম আযাদ ও প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম।   সঙ্গীত তার কাছে নিজের মতোই প্রিয়। তিনি সঙ্গীতকে মনে করেন নিজের অনুভব। এ জন্যই তাঁর পক্ষে বাংলা সংগীতের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার সম্ভব হয়েছে।  

প্রেম, দ্রোহ, দেশপ্রেম, মরমিবোধ, মানবতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, জীবনপ্রলয়, প্রকৃতি, বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন, দেশপ্রেম ও সর্বজনীনতা তার গানের মুল আলেখ্য।এ সকল বিষয়সহ জীবন-মননে অনিবার্য প্রতিটি বিষয় প্রাসঙ্গিকতা ওঠে এসেছে গানে গানে ইতিহাস হয়ে। এটাকে গানৈতিহাস বলা যায়। গানে এমন নতুন ধারা, এমন নতুন চিন্তা, এরূপ নতুন দৃষ্টি আর দেখা যায় না। সংগীতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করলেও তা কেবল শ্রদ্ধানিবেদিত আর্ষতা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম নিজ ঋদ্ধতায় এতই পরিপক্ক ও সচেতন যে, সৃষ্টির জন্য তাঁর কাউকে অনুসরণ করা আবশ্যকতা নেই। 

ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের তুলনা কেবল তাঁকে দিয়ে করা যায়। এখানেই তার পরিপূর্ণ সার্থকতা, এ জন্যই তিনি বাংল সংগীতের কাণ্ডারি।
 

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন