বোঝাবুঝির বোঝা / Sumanta Barman

বোঝাবুঝির বোঝা কমলেও কমতে পারে—
শুবাচে 'বোঝা' আর 'বুঝি' নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছে ৷ 'বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ' পুস্তকটির কিছু অংশ পড়ে 'বোঝাবুঝি' বিষয়ে আমি যা বুঝলাম—
কী সমাপিকা ক্রিয়া, কী অসমাপিকা ক্রিয়া— দুয়েরই বিভক্তি বর্জিত মূল অংশই হলো ধাতু ৷ ধাতুতে বিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ তৈরি হয় ৷ বিভক্তি যুক্ত হলে, ধাতুর শরীরে অল্প-বিস্তর পরিবর্তনও আবার ঘটতে পারে ৷ 'খা' ধাতুটির 'খাই' শব্দটিতে দেখা যায় বিভক্তি 'ই' যুক্ত হলেও ধাতুর কোনো পরিরর্তন হয় নি, অর্থাৎ অপরিবর্তিত ধাতুরূপটি 'খা' ৷ কিন্তু 'খা' ধাতুটির 'খেলাম' শব্দটিতে দেখা যাচ্ছে বিভক্তি 'লাম' যুক্ত হওয়ায় 'খা' পরিবর্তিত হযেছে, আর পরিবর্তিত ধাতুরূপটি 'খে' ৷ অর্থাৎ 'খা' ধাতুটির দুটি রূপ 'খা' ও 'খে' দেখতে পাওয়া যায় ৷ 'খা' রূপের কিছু ক্রিয়াপদ- খাচ্ছিস, খাবেন, খায়,.....৷ 'খে' রূপের কিছু ক্রিয়াপদ- খেতে, খেয়ে, খেলেন,...৷
তেমনি, 'বুঝ্' ধাতুর শব্দগুলোতে 'বুঝ্' ও 'বোঝ' দুটি রূপ আসে—
যেমন-
*তিনি বুঝতে পারছেন না ৷(বুঝ্)
*তুমি তাকে বোঝাও ৷(বোঝ্)
*তিনি বেশ বোঝেন ৷(বোঝ্)
*বুঝলে-ও, বোঝাও ৷(বুঝ্, বোঝ্)
বাক্যগুলোর ক্রিয়াপদগুলোতে কখনও 'বুঝ্', আবার কখনও 'বোঝ্' – এই দুটি রূপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ৷
বাংলা রূপতত্ত্বের মার্কিন আলোচক ফার্গুসন (Ferguson,1945) ধাতুর এই পরিবর্তিত বা অপরিবর্তিত রূপের নাম দিয়েছেন 'কাণ্ড' ৷ কাণ্ড দুটির একটিকে 'উচ্চ কাণ্ড' ও আরেকটিকে 'নিম্ন কাণ্ড' বলেছেন ৷ এখানে নিম্ন কাণ্ড 'বোঝ্' আর উচ্চ কাণ্ড 'বুঝ্' ৷
কোথায় উচ্চ কাণ্ড বা বুঝ্ আর কোথায় নিম্ন কাণ্ড বা বোঝ্ ব্যবহৃত হয়ে থাকে–তা-ই আলোচনার বিষয় ৷
সাধারণত ক্রিয়াপদগুলো এভাবে গঠিত হয়—
নিম্ন কাণ্ড+আ-বিভক্তি এবং
উচ্চ কাণ্ড+ই,উ-বিভক্তি ৷
অর্থাৎ আ-কার(বিভক্তি) যুক্ত হলে 'বোঝ্' কাণ্ডের সাথে যুক্ত হবে ৷ যেমন, বোঝা, বোঝান, বোঝাও ইত্যাদি ৷
আবার ই,উ বা ই,উ-কার (বিভক্তি) যুক্ত হবে 'বুঝ্' কাণ্ডের সাথে ৷ যেমন, বুঝি, বুঝুন, বুঝুক ইত্যাদি ৷
এখন 'বুঝতে', 'বুঝে'(অসমাপিকা), 'বুঝছি' শব্দগুলো লক্ষ করি ৷ শব্দগুলোতে ই,উ বা ই, উ-কার(বিভক্তি) যুক্ত নেই, তবু 'বুঝ্' কাণ্ডটি আসবার কী কারণ? কারণ এই যে, তে, এ, ছি বিভক্তিগুলো বস্তুত ইতে, ইয়া, ইতেছি বিভক্তির সংক্ষিপ্ত রূপ ৷ এখানে বুঝ্+ইতে(বিভক্তি)=বুঝিতে> বুঝতে, বুঝ+ইয়া(বিভক্তি)=বুঝিয়া> বুঝে, বুঝ্+ইতেছি(বিভক্তি)=বুঝিতেছি> বুঝছি ইত্যাদি ৷ অর্থাৎ এখানেও ই,উ বা ই,উ-কার(বিভক্তি)-এর ফলেই 'বুঝ্' কাণ্ডের ব্যবহার ৷
ধাতুর উচ্চ কাণ্ড ও নিম্ন কাণ্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সংশয় দেখা দেয়, তা নিচের অংশটুকু মনে রাখলে নিরসন হতে পারে ৷
'নিম্ন কাণ্ড' বা 'বোঝ্' ব্যবহৃত হয়—
☞সাধারণ বর্তমান কালের- ১.'সে', ২.তুমি'', ৩.'আপনি'-এর ক্রিয়াপদে এবং
☞বর্তমান অনুজ্ঞা-য় ৪.'তুমি', ৫.'তুই'-এর ক্রিয়াপদে ৷
যেমন—
☞সাধারণ বর্তমান:
১.সে বোঝে ৷( বোঝ্+ এ)
২.তুমি বোঝো ৷
৩.আপনি বোঝেন ৷
☞বর্তমান অনুজ্ঞা:
৪.তুমি বোঝো ৷
৫.তুই বোঝ্ ৷
অতএব (১),(২),(৩),(৪),(৫) এই পাঁচটি ক্ষেত্র এবং ক্রিয়াপদ গঠনের নিয়ম দুটি "নিম্ন কাণ্ড(বোঝ্)+আ" ও "উচ্চ কাণ্ড(বুঝ)+ই,উ" মনে রাখলে 'বোঝ','বুঝ' -এর ঝামেলা সামাল দেওয়া যেতে পারে ৷
************************
এ অংশটুকু এড়িয়ে গেলেও চলবে—
প্রযোজক/নামধাতুর ক্রিয়া:
"নিম্ন কাণ্ড+আ(বিভক্তি)" অনুসারে-
বোঝাই, বোঝাচ্ছি, বোঝাব, বোঝান, বোঝাতে চাই, বোঝা যাক,.....৷
আবার,
"উচ্চ কাণ্ড +ই,উ-বিভক্তি" অনুযায়ী - বুঝিয়েছি,বুঝিয়েছিলাম,..৷
☞"উচ্চ কাণ্ড(বুঝ্)+ ই,উ" অনুযায়ী অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে অর্থাৎ সকল পুরুষ ও কালের ক্রিয়ায় , ভবিষ্যত অনুজ্ঞায়, অসমাপিকা ক্রিয়ায় ধাতুর 'উচ্চ কাণ্ড' (বুঝ্) ব্যবহৃত হয়ে থাকে ৷
যেমন—
বুঝি, বুঝব,বুঝতে চাই, বুঝছিলেন, বুঝে আয়,তুমি বুঝো(বুঝিও).......৷
****************
'বুঝ্' ধাতুর সাথে একই গণ বা গুচ্ছভুক্ত আরো কিছু ধাতুর উচ্চ কাণ্ড-নিম্ন কাণ্ড তুলে ধরছি:
খুঁজ্-খোঁজ্, খুল-খোল্, শুন্-শোন্, ঘুর্-ঘোর্, উড়্-ওড়, খুঁড়্-খোঁড়্, চুষ্-চোষ্, জুড়্-জোড়্,ঝুঁক-ঝোঁক্, ঠুক্-ঠোক্,ঢুক্-ঢোক্,তুল-তোল্, দুল্-দোল্, উঠ্-ওঠ্, ফুট্-ফোট্, ভুল-ভোল্ ইত্যাদি ৷ এই গুচ্ছটির ধাতুগুলো দ্বারা একই প্রণালীতে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়ে থাকে ৷ তাই উঠে,ওঠে কিংবা ঢোকে,ঢুকে ক্রিয়াপদগুলো গঠনের ধারণাও একইভাবে পাওয়া যায় ৷
শুধু 'বুঝা' বা 'বোঝা' নয়; দেখ্(উচ্চ কাণ্ড)—দ্যাখ্( নিম্ন কাণ্ড), লিখ্(উচ্চ কাণ্ড)—লেখ্( নিম্ন কাণ্ড), বোল্ (উচ্চ কাণ্ড)—বল্(নিম্ন কাণ্ড) এ-গুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই নিয়ম দেখা যায় ৷
সূত্র: বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, সংস্করণ ২০১২ ৷ পৃষ্ঠা ২৫৬ ,ক্রিয়াপদ ( সমাপিকা) ৷
উচ্চ কাণ্ড সৃষ্টির কারণ বা উচ্চ কাণ্ড- নিম্ন কাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বইটি দেখতে পারেন ৷

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন