আলোচনার পরিবেশ / শাহিদুল হক - শুবাচ

আলোচনার পরিবেশ
(রম্য রচনা)
আমার বউয়ের নাম`পঞ্চ’। তাকে আমি আদর করে পাঁচ বলে ডাকি। তার মুখটা পাঁচের মতো এ জন্য না, বৈবাহিকসূত্রে প্রাপ্ত ভালবাসার আতিশয্যেই তাকে `পঞ্চ’ না বলে `পাঁচ’ বলে ডাকি। কিন্তু এত নাম থাকতে তার মা-বাবা তার নাম ‘পঞ্চ’ রাখতে গেল কেন, তা আমি জানি না। আর জানবোই বা কেমন করে। ওদের বাড়ি আমাদে গ্রাম থেকে তিন গ্রাম দক্ষিণে। আমাদের গ্রামে বৃষ্টি হলে ওদের গ্রামে সেই বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যেতে অনেক সময় লাগে। কেননা, মাঝের দূরত্বটা দু-তিন কিলোমিটার তো হবেই। তা ছাড়া বড়লোক-শ্বশুর কন্যার নাম-রহস্য জানা তো দূরের কথা বিয়ের আগে তার চেহারা-ছুরতও দেখা-শোনার কোন প্রয়োজন বোধ করি নি। বিয়ের পরে আমার বউ বড় ধরনের কোন ভুলভ্রান্তি করে ফেললে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে দান-দক্ষিণাসহ সুন্দর সুন্দর পরামর্শ তো পেয়েই থাকি। তাঁরা ছোটখাট অভিযোগ বা ভুলভ্রান্তির ক্ষেত্রে দান-দক্ষিণা ছাড়াই কেবল পরামর্শ দিয়ে থাকেন, ‘তোমরা নিজেরা বসে আলোচনা করে মিটমাট করে নিও।’ আমি বহুবার আলোচনা করার প্রস্তাব দিয়েছি। হিতে বিপরীতও হয়েছে। আমার শাশুড়ী একদিন বললেন, ‘বাবা, আমার মেয়ের সেই ছোটবেলা থেকেই পঞ্চমুখে কথা বলার অভ্যাস। তুমি কিছু মনে করো না।’ আহা! কীযে বলেন না! এটা কি কম গুণের কথা! আমি কেন মনে করতে যাব। দশমুখে কথা বললেও কিচ্ছু মনে করবো না। কথায় আছে, যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও নাকি সহ্য হয়। আমাদের দেশের জোটের শরিক দলগুলো দুধ খেয়ে লাখি সহ্য করে যাচ্ছে না? করছে। তাহলে আমার বেলায় আপত্তি থাকাটা মোটেও ভালো কথা না। আমি আমার সহ্য শক্তিটাকে দিনের পর দিন বাড়িয়েই চলেছি। এর জন্য আমাকে জিমে যেতে হয় না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই এই সহ্যশক্তির পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। আমি হলফ করে বলতে পারি, আজও আমার এতটুকু ধৈর্যচূতি ঘটে নি। “বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা।” আমার সহ্যশক্তি অর্জনের পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমোঘবাণী বিয়ের পর থেকে দারুণভাবে কাজ করে আসছে। জয় ঠাকুর। ঠাকুরের জয়। “বিপদে যেন আমি না করি ভয়।” এই তো, গত কাল অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলাম, আমার বউ একজনের সাথে পার্কে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। আমি দেখেও না দেখার ভাণ করে বাসায় চলে এলাম। ভাবলাম- আমি দেখি নি, সেটাই ভালো। কিন্তু কৌতূহল চেপে রাখতে আর পারলাম না। পুরুষের কৌতূহল বলে কথা! তাই সন্ধায় চায়ের টেবিলে এ বিষয়ে জানার আগ্রহটা দেখাতেই সে চোখ দুটো পাকিয়ে যেভাবে আমার দিকে তাকালো তাতে আমার কম্ম সারা। তবে দয়া করে পালটা প্রশ্ন করে বললো, ‘তুমি পার্কে গিয়েছিলে কেন সেই কথা আগে বলো? তোমার স্পর্ধা তো কম না, তুমি আমাকে সন্দেহ কর? আর আমার পিছে পিছে গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াচ্ছ, না! এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে তোমার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ, এ আমি একদম সহ্য করব না!’
কীযে বল না! তোমাকে সন্দেহ করতে যাব কেন? তুমি আমার একমাত্র স্ত্রী পঞ্চ বেগম! তোমার বাদাম খেতে মনে চেয়েছে বললেই তো পারতে। আমি এনে দিতাম।
‘ন্যাকামু! এনে দিতাম!! তিনি আমার প্রাইভেট স্যার। অনেক দিন পর দেশে ফিরেছেন। পথে দেখা হলো। তাই স্যারের সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে কাটিয়েছি। তাও উনাকে এর কৈফিয়ত দিতে হবে।’
তা ঠিক আছে। ঠিক আছে। প্রাইভেট স্যার বলে কথা। কিন্তু এর কয়েক দিন আগে দেখলাম, তুমি আরেক ছেলের সাথে সোনালি রেস্টুরেন্টে বসে প্রাইভেট কফি খাচ্ছ নাকি খাওয়াচ্ছ ?
‘ঠাস’ ‘ঠাস’ করে কয়েকটা শব্দ হলো। এর উৎপত্তিস্থল কেউ জানে না, আর জানবেও না। শব্দ শুনে আমি বরং চুপ করে গেলাম। বললাম, না মানে- তুমি চাইলেই তো আমি কফি এনে দিতে পারতাম। তা ছাড়া তোমার মা-বাবা কিন্তু অনেকবার বলেছেন, আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হলে আমরা যেন তা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে ফেলি। তাই আমি এ অবস্থায় আলোচনার প্রস্তাব করছি।
ভেবে দেখলাম, আলোচনা করার মতো পরিবেশ আর এ মুহূর্তে নেই। এ রকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তার গুণাগুণ নিয়ে কোন আলোচনা চলতেই পারে না। কেননা, এ অবস্থায় পুনরায় কোন কথা বললে নির্ঘাত আজকের রাতটাও আমাকে বাথরূমে বন্দি হয়ে কাটাতে হবে। অভিজ্ঞতা থাকলে যে কোন ধরনের পরিস্থিতি সহজেই মোকাবেলা করা যায়। আমার অর্জিত অভিজ্ঞতা আমি এই মুহূর্তে কাজে লাগিয়ে চুপ করে থাকলাম। অথচ আজ সারাদিন ভেবেছিলাম, আমি ধূমপান করি না। অথচ প্রায়ই প্রায়ই বেডরূমে সিগারেটের পুড়া অংশ পড়ে থাকতে দেখি। আজ এর রহস্যটা একটু আলোচনা করে জেনে নেব। কিন্তু আলোচনার পরিবেশ না থাকলে আলোচনা করে কোন লাভ হয় না।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন