বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুলের মহড়া / ড. মোহাম্মদ আমীন
প্রথম ছবি
গত ১/৯/২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে অনুষ্ঠিত বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কিয়দংশের অংশের ছবি নিচে দেওয়া হলো। দেখুন অর্ধপৃষ্ঠার একটি বাংলা লেখায় পিএসসি কত ভুল করেছে। শুবাচে দেওয়া জনাব শফিক মোরশেদের পোস্ট হতে ছবিগুলো নেওয়া। জনাব শফিক মোরশেদ ও জনাব খুরশেদ আহমেদ কয়েকটি ভুল চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও আরও অনেক ভুল এবং অসংগতি এখানে রয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরীক্ষা। এতে ভুল থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। পরীক্ষার গুণগত মান রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের তারা এক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগী না হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের ভুল হচ্ছে।
একটু খেয়াল করলে অরও কিছু ভুল পাওয়া যাবে। শব্দচয়ন ও বাক্য গঠনেও বেশ কিছু অসংগতি আছে। এছাড়া আধুনিক বাংলা সম্পর্কে লেখকের অনভিজ্ঞতার ছাপও দেখা যায়।যেমন : ‘গৌরব আর গর্ব’ বাক্যাংশে ‘গৌরব’ ও ‘গর্ব’ সমার্থক শব্দ। এমন উচ্চমর্যাদার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এমন উদ্দেশ্যবিহীন শব্দচয়ন যথোপযুক্ত মনে হয়নি। অধিকন্তু এখানে ‘আর’ শব্দের বদলে ‘ও’ দেওয়া উচিত ছিল। কারণ বাক্যাংশ বা বাক্য সংযুক্তিতে ‘আর/এবং’ বসে। পদ-সংযোগে বসে ‘ও’।
‘ভীষণভাবে আপ্লুত করে’ বাক্যাংশে বাক্য বিবেচনায় ‘ভীষণভাবে’ পদটি বেমানান হয়েছে। আপ্লুত আনন্দ-প্রকাশক শব্দ। এর সঙ্গে ‘ভীষণ’ বিশেষণ মানানসই হয়নি। ভীষণ দিয়ে সাধারণত নিরানন্দময়/ ভয়ানক কিছু প্রকাশ করা হয়। প্রত্যাশিত প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া কখনও ‘ভীষণ’ হয় না, এটি হয় ‘মধুর, দারুণ, চমৎকার’ প্রভৃতি।
‘নতুনের পানে ছুটে চলা’ বাক্যাংশে ‘পানে’ শব্দটি আধুনিক গদ্য-রচনায় ব্যবহার করা হয় না।এটি কবিতায় ব্যবহৃত হয়। এখন আধুনিক কবিতাতেও শব্দটির তেমন ব্যবহার দেখা যায় না। ‘পানে’ বসানো ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ না-হলেও আধুনিকতা, প্রচলন, প্রমিত বাক্য গঠন- প্রভৃতি বিবেচনায় পিএসসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য গৌরবের কিছু নয়।
‘থাকবে এবং অনন্তকাল থাকবে’ বাক্যাংশে ‘থাকবে’ ও ‘অনন্তকাল থাকবে’ বাগ্ভঙ্গি দুটোর একই সঙ্গে ব্যবহার বাক্যকে দুর্বল ও দিত্ব দোষে দুষ্ট করে দিয়েছে। এখানে, আদর্শ বাক্য গঠনে প্রাবন্ধিকের অভিজ্ঞতার অভাব, তৎসঙ্গে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এছাড়াও বাক্য গঠনে আরও প্রচুর অসংগতি ও অনভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে।ছবিতে চিহ্নিত করে দেওয়া ভুল ছাড়াও আরও কিছু বানানগত ভুল প্রশ্নপত্রে রয়েছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে পরিদৃষ্ট ভুলগুলো নিচে দেওয়া হলো :
শুধুমাত্র> শুধু/মাত্র; বাঙালীর> বাঙালির; বহ্নি শিখা> বহ্নিশিখা; বাঙালীর> বাঙালির; বাঙালীর> বাঙালির; সব কিছু>সবকিছু; জাতিসত্ত্বার> জাতিসত্তার; লক্ষ্য> লক্ষ; যে জানতে চায়> সে জানতে চায়; জাতিসত্ত্বার> জাতিসত্তার; ৭১ এর> একাত্তরের; একুশের বইমেলা> একুশের গ্রন্থমেলা; স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে> স্বাধীনতা দিবসে ও বিজয় দিবসে; প্রতিটি সদস্যকে> প্রত্যেক সদস্যকে; পতাকাসহ ও> পতাকাসহ; শহীদ মিনার> শহিদ মিনার প্রভৃতি। ভালোভাবে লক্ষ করলে আরও ভুল পাওয়া যেতে পারে।
৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখ অনুষ্ঠিত বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ভুলগুলো আরও ভয়ঙ্কর। দেখুন প্রশ্নপত্রের ছবি। কত অবহেলা ও অজ্ঞতার মিলন ঘটলে এমন ভুল হতে পারে তা ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে।
আরও ভুল : দ্বীপ এর> দ্বীপের; কি>কী; ব-দ্বীপ সমূহ> ব-দ্বীপসমূহ; কি>কী; যাদুঘর এর> যাদুঘরের; শহীদ মিনার>
তৃতীয় ছবি
শহিদ মিনার; কি? কী; বাঙ্গালী> বাঙালি; আন্দোলন এর> আন্দোলনের; গণঅভ্যুত্থান এর> গণঅভ্যুত্থানের; বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের> ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের; মূলনীতিগুলি> মূলনীতিগুলো; কি কি> কী কী; বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ অনুসারে ব্যাখ্যা করুন> গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে ব্যাখ্যা করুন।
কি কি> কী কী; কি বুঝেন> কী বুঝেন; কি> কী; উনারা> তাঁরা; করেন> করেছেন; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের> সুপ্রিম/সুপ্রীম কোর্ট, বাংলাদেশের; উক্ত> ওই; সংক্ষেপে পেশাগত জীবনী> সংক্ষেপে তাঁর পেশাগত বিবরণ; বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক খেতাব প্রাপ্তি সমূহ> বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অর্জিত আন্তর্জাতিক খেতাবসমূহ; মৃত্যুদন্ড> মৃত্যুদণ্ড; কি বুঝায়> কী বুঝায়; কি> কী; পদের নাম ও সংক্ষেপে দায়িত্ব লিখুন > পদের নাম ও সংক্ষেপে ওই পদসমূহে অধিষ্ঠ ব্যক্তির দায়িত্ব বর্ণনা করুন; বাংলাদেশের নির্বাচনের> বাংলাদেশের নির্বাচনে> বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে/ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে / ( অন্য কোনো নির্বাচনে); পর্যবেক্ষণ দলসমূহের> পর্যবেক্ষণকারী/পর্যবেক্ষক দলসমূহের; ভূমিকা/ গুরুত্ব> ভূমিকা অথবা গুরুত্ব।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে’ বাক্যাংশটি হাস্যকর। এর দ্বারা বাংলাদেশকে নির্বাচন করার কথা বুঝায়।
এবার অতীতের দিকে যাওয়া যায়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুলাই, শুক্রবার অনুষ্ঠিত ৩০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ২ নম্বর সেটের ইংরেজি অংশে নির্দেশনা ও প্রশ্নে ব্যাপক অসংগতি পাওয়া গেছে। ১, ২ ও ৩ নম্বর সেটের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়।তন্মধ্যে ২ নম্বর সেটের ইংরেজি অংশে প্রশ্নের সঙ্গে নির্দেশনার সামঞ্জস্য ছিল না।
২ নম্বর সেটের সঙ্গে অন্য ২টি সেটের তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২ নম্বর সেটের ৬২ ও ৬৩ নম্বর প্রশ্নের নির্দেশনায় শূন্যস্থান পূরণের কথা বলা হলেও এ সংক্রান্ত ১টি প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে নির্দেশনার উপরে। অন্যদিকে শুণ্যস্থান পূরণের নির্দেশনায় চলে এসেছে বানান ঠিক করার অন্য একটি প্রশ্ন। বানান ঠিক করার নির্দেশনা-সম্বলিত ২টি প্রশ্নের ১টিতে বাচ্য পরিবর্তনের এবং অন্যটিতে প্রশ্ন নিয়ে আসা হয়েছে। আবার বাচ্য পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়ে করা ৩টি প্রশ্নের ২টিতে বাগধারা পরিবর্তনের প্রশ্ন নিয়ে আসা হয়েছে। বাগধারার নির্দেশনায় ৩টি প্রশ্ন থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ২টি। এরমধ্যে আবার ১টিতে ব্যাকরণগত শুদ্ধি/অশুদ্ধি নির্ণয় সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে আসা হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাকরণগত শুদ্ধি/অশুদ্ধি নির্ণয়ের ২টি প্রশ্ন থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৩টি। এখানে শূন্যস্থান পূরণের ২টি প্রশ্ন নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি প্রশ্নগুলোরও একই অবস্থা।
৩৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ২ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে যে কতগুলো ভুল হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। Mobile Phone বানান লিখতে কারও ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিসিএস-এর প্রশ্নপত্রে লেখা হয়েছে ‘মোবাইল পোন’ (Mobile Pone)! ‘মোবাইল ফোন’ নয়।
প্রশ্নটি ছিল : Mobile Pone-এর কোনটি input device নয়? চার নম্বর সেটের (দোলনচাঁপা) ১৮৬ নম্বর প্রশ্নে ‘ফোন’ ‘পোন’-এ রূপান্তরিত হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের কাছেই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। একই সেটের ১৩৩ নম্বর প্রশ্নে রয়েছে, বর্তমানে NAM এর সদস্য সংখ্যা কত ? উত্তরে দেয়া আছে ক ) ৩৩, খ) ১৫, গ)৭৭, ঘ) ২১। অথচ এর ঠিক উত্তর হবে ১২০। বিসিএসের মতো এত বড় পরীক্ষায় এ ধরনের ভুল দুঃখজনক।
১৮২ নম্বর প্রশ্নের উত্তর ছিল ভুল। এই প্রশ্নে বলা হয়, দুটি সমান্তরাল রেখা কয়টি বিন্দুতে ছেদ করে? উত্তর দেয়া আছে- ক) ৪, খ) ২, গ) ৮, ঘ) ১৬। এখানেও নেই সঠিক উত্তর। দুটি সমান্তরাল রেখা কখনই একে অপরকে ছেদ করে না। এটা যারা জানে না তারা কিভাবে বিসিএসের প্রশ্ন করে? এ প্রশ্ন হলেও বলা উচিত ছিল যে, কোনটি নয়। তার না করে যা হয়েছে তা হলো হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা।
দোলনচাঁপা সেটের ১৪৩ নম্বর প্রশ্নে ভুল করা হয়েছে। এখানে বলা হয়, জীব জগতের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর রশ্মি কোনটি? উত্তরে ক) আলফা রশ্মি, খ) বিটা রশ্মি, গ) গালা রশ্মি, ঘ) আল্ট্রাভায়োলেট রশ্নি। সঠিক উত্তর গামা রশ্মি হলেও
লেখা হয়েছে ‘গালা রশ্মি’। আরেকটি প্রশ্নে লেখা হয়েছে সরকারের বড় অর্জন কোনটি। চারটি অর্জনের কথা বলা হলেও তার প্রত্যেকটিই সরকারের অর্জন। বড় অর্জন কোনটি এমসিকিউতে এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। এটা তো একেক জনের কাছে একেক রকম হবে। বাংলা বিষয়ে একটি প্রশ্নে বলা হয়েছে, গ্রামের প্রাধান্য পেয়েছে কোন প্রবন্ধে? যে চারটি প্রবন্ধের কথা বলা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই প্রাধান্য পেয়েছে গ্রাম। এমন অসংখ্য ভুলে ভরা প্রশ্নে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরীক্ষার্থীরা।
এমন ভুলের অনেক কারণ। হয়তো প্রশ্ন যারা করেন, তারা মনোযোগ দিয়ে কাজটা করেন না। মডারেশন যারা করেছেন তারাও মনোযোগ দেননি। অনেকে এমন প্রশ্ন করে বসেন, যে প্রশ্নের যথার্থউ ত্তর, নিজেই জানেন না। আবার অনেকে এমন আছেন, যারা বিসিএস-এর মতো পরীক্ষার প্রশ্ন করার উপযুক্ত নন।
বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি-সহায়ক লিংক:
গুরুত্বপূর্ণ লিংক
প্রেসক্রিপশনে RX লেখার কারণ
Comments
Post a Comment