জ্যোতির্ময় জ্যোতিষ্মান পার্থসারথী বসু, অভিজিৎ অভি ও খুরশেদ আহমেদ/ ড. মোহাম্মদ আমীন
দুটি শব্দের বানান নিয়ে আমার মনে একটি দীর্ঘকালীন জিজ্ঞাসা আছে। বন্ধুদের দু-চারজনকে বলেওছিলাম, একবার ফেসবুকেও লিখেছিলাম। নিজেও উত্তর খুঁজেছি, তাতে খোঁজার পরিসরটা একটু ছোট হয়েছে হয়তো, কিন্তু সন্তোষজনক মীমাংসা মেলেনি। শব্দদুটো কী-কী বলেই ফেলি। জ্যোতির্ময় এবং জ্যোতিষ্মান।জ্যোতি শব্দে স্-জাত বিসর্গ আছে। শব্দটি জ্যোতিঃ। বাংলায় বিসর্গ দেওয়া হয় না। লেখা হয় জ্যোতি বসু, অপূর্বজ্যোতি।কিন্তু জ্যোতিঃ যখন পূর্বপদ হয়ে অপর কোনও তৎসম শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন সন্ধি করতেই হয় এবং তা করতে হয় সংস্কৃত বিসর্গসন্ধির নিয়ম মেনে। এইভাবে আমরা পাই জ্যোতিশ্চক্র, জ্যোতীরূপ, জ্যোতিরিন্দ্র, জ্যোতির্গময়, জ্যোতির্বলয়, জ্যোতির্ময়।
এরকম একটা সূত্র মনে পড়ছে যে অ ও আ ভিন্ন অপর কোনও স্বরের পরে যদি র্-জাত বা স্-জাত বিসর্গ থাকে এবং পরবর্তী পদের প্রথমে যদি স্বরবর্ণ বা বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম বর্ণ অথবা য ল ব হ থাকে তবে বিসর্গস্থানে র্-এর আগম ঘটে। (ট্রেনযাত্রায় বসে স্মৃতি থেকে এই সূত্রটি লেখা, সূত্রোল্লেখে একটু-আধটু ভুল থাকলে তা ক্ষমণীয়।) এই হিসেবে জ্যোতির্বলয় জ্যোতির্ময় প্রভৃতি শব্দকে তো বোঝা যাচ্ছে। জ্যোতিঃ+ময়=জ্যোতির্ময়। ময়ট্ প্রত্যয়ের 'ট্' ইৎ গেল, 'ময়' থাকল।তা-হলে জ্যোতিঃ+মান=জ্যোতিষ্মান কেন? জ্যোতির্মান কেন নয়? জ্যোতিঃ-র সঙ্গে মতুপ্ লাগানো হল, 'উপ্' ইৎ গেল, হল জ্যোতিষ্মৎ, তার পুংলিঙ্গের প্রথমা বিভক্তির একবচনে জ্যোতিষ্মান্। বাংলায় হসন্ত চিহ্নটি বাদ গেল। দু জায়গায়ই আগে জ্যোতিঃ শব্দটি আছে, পরে প-বর্গের পঞ্চম বর্ণ 'ম' আছে, এবং দু জায়গায়ই পরের পদদুটি তদ্ধিত প্রত্যয়। তাহলে রেফ না হয়ে 'ষ্' কেন?
আর শুধু জ্যোতিষ্মান তো নয়, অর্চিষ্মান চক্ষুষ্মান বপুষ্মান আয়ুষ্মান প্রভৃতি অনেক শব্দই আছে এরকম। তবে কি মতুপ্ প্রত্যয়ের বেলায় আলাদা কোনও সূত্র আছে? আমি একবার কোথায় যেন দেখেছিলাম (যথারীতি মনে নেই কোথায়) 'ই' বা 'উ'-এর পর বিসর্গ থাকলে এবং পরে তকারাদি প্রত্যয় থাকলে বিসর্গস্থানে 'ষ্' হয়। এই 'তকারাদি' প্রত্যয়গুলি কী-কী সেটা আমি বের করতে পারিনি। এর মধ্যে কি মতুপ্ আছে? বন্ধুরা কেউ যদি বলতে পারেন দীর্ঘদিনের একটা সংশয় ঘোচে।
জনাব অভিজিৎ অভির মন্তব্য দেখুন। তারমতে, মতুপ ছাড়াও এমন ব্যত্যয় দেখি। যেমন চতুঃ+দিক = চতুর্দিক কিন্তু চতুঃ+চত্বারিংশ=চতুশ্চত্বারিংশ(হওয়া উচিত
চতুর্চত্বারিংশ)। সংসদ বাঙ্গালা অভিধান (৪র্থ সংস্করণ) অনুযায়ী জ্যোতিষ্মান, জ্যোতিষ, জ্যোতিষ্ক ও জ্যোৎস্না এই শব্দগুলো জ্যোতিঃ(জ্যোতিস্) শব্দ হতে উদ্ভূত; অর্থাৎ এখানে জ্যোতিঃ এর বিসর্গ স-জাত। অন্যদিকে জ্যোতির্ময়, জ্যোতির্বিদ, জ্যোতির্মণ্ডল প্রভৃতি যে জ্যোতিঃ হতে উদ্ভূত, তার বিসর্গ র-জাত। সুতরাং আমরা এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারি, জ্যোতির্ ও জ্যোতিস্ দুটি পৃথক পদ এবং উভয়েরই সংক্ষিপ্ত রূপ জ্যোতিঃ হওয়ায় তা বিভ্রান্তির সূচনা করেছে।
জনাব খুরশেদ আহমেদ লিখলেন, আমি কিছু রেফারেন্স-বই পড়ে যেটুকু বুঝলাম, বিসর্গ-সন্ধি-সাধিত শব্দ যেগুলো বাংলায় ব্যবহৃত হয়, তা সবই নির্মিত হয়েছে সংস্কৃত
ব্যাকরণের কারখানায়, সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে। সংস্কৃত-প্রত্যয়-সাধিত শব্দ 'জ্যোতির্ময়' ও 'জ্যোতিষ্মান' নির্মাণে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃত প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের মিলনের সময় সংস্কৃত সন্ধির কোন নিয়ম প্রযুক্ত হয়েছে ও কোন নিয়ম প্রযুক্ত হয়নি এবং কেন ওই নিয়ম প্রযুক্ত হয়েছে বা হয়নি, সংস্কৃত-না-জানা বাংলাভাষী আমাদের পক্ষে তা উদ্ধার করা দুরূহ। এ অবস্থায়, সংক্ষিপ্ত ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ [সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়; বেঙ্গল পাব্লিশার্স, কলিকাতা; প্রথম সংস্করণ, শ্রাবণ ১৩৫২ (আগস্ট ১৯৪৫)] পড়ে আমি সান্ত্বনা পাই:"সংস্কৃতে আরও বহু ধ্বনি-পরিবর্তনের উদাহরণ আছে, সেগুলির মধ্যে কতকগুলি নিয়ম-সিদ্ধ, কতকগুলি আপাত-দৃষ্টিতে নিয়ম-বহির্ভূত, কিন্তু বাঙ্গালায় আগত সেই-রূপ ধ্বনি বা বর্ণপরিবর্তনযুক্ত শব্দ তত বেশী নাই এবং যেখানে সেই-রূপ শব্দ পাওয়া যায়, সেখানে বিশ্লেষ বা উৎপত্তির দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া পুরা শব্দটি আয়ত্ত করাই সহজ।"
Comments
Post a Comment