বাংলা বানানরীতির বর্ণভেদ-৩ / শাহিদুল হক

বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে বলা হয়েছে তৎসম শব্দে ট, ঠ বর্ণের পূর্বে ‘ষ’ হয়। যেমন: বৃষ্টি, দৃষ্টি, সৃষ্টি, মিষ্টি, পৃষ্ঠা, নিষ্ঠা ইত্যাদি। কিন্তু বিদেশি শব্দে এই ক্ষেত্রে ‘স’ হবে। যেমন: স্টল, স্টাইল, স্টিমার ইত্যাদি।
আমার প্রশ্ন এখানেই। কেন আমরা তৎসমের জন্য এক নিয়ম আর বিদেশি শব্দের জন্য ভিন্ন নিয়ম পোষণ করব? এর
উত্তর আমি আজও খুঁজে পাইনি। যে কারণে অকারণে বর্ণের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রিয় বন্ধুগণ, এর কোনো উত্তর আপনাদের কাছে থাকলে দয়া করে আমাকে জানালে আমি খুবই উপকৃত হব। আমার কাছে এই নিয়য়ের আংশিক অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করার পূর্বে বর্ণপরিচয়ে গেলে ভালো হয়। চলুন, ঐ রাজ্যে একটু ঘুরে আসি।
ক) ‘স্ট’ ও ‘ষ্ট’ মাঝের দূরত্বটা বোঝার জন্য প্রথমে ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণস্থান বিবেচনায় আনা যাক:
১। নিচের ঠোঁট ও ওপরের ঠোঁট মিলিত হয়ে উচ্চারিত ধ্বনির নাম ‘ওষ্ঠ্য‘
২। জিভের ডগা ও ওপরের পাটির দাঁত মিলিত মিলিত হয়ে উচ্চারিত ধ্বনির নাম ‘দন্ত্য‘
৩। জিভের ডগা ও তালু মিলিত হয়ে উচ্চারিত ধ্বনির নাম ‘তালব্য‘
৪। জিভের পিছন ও ভিজের মূলের ঝিল্লি মিলিত হয়ে উচ্চারিত ধ্বনি ‘জিহ্বামূলীয়‘
৫। জিভের পেছন ও জিহ্বামূলের শেষপ্রান্ত মিলিত হয়ে উচ্চারিত ধ্বনি ‘কণ্ঠনালীয়।
খ) এবার উক্ত নাম/ উচ্চারণস্থান অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিবিন্যাস দেখা যাক:
১. কণ্ঠ্য বা জিহ্বামূলীয় বা পশ্চাৎ তালুজাত: ক খ গ ঘ ঙ হ
২. তালব্য বা অগ্রতালুজাত : চ ছ জ ঝ ঞ শ
৩. মূর্ধন্য বা দন্তমূলীয় : ট ঠ ড ঢ ণ ড়
৪. দন্ত্যমূলীয় : র ল স জ ন
৫. দন্ত্য : ত থ দ ধ ন
৬. ওষ্ঠ্য : প ফ ব ভ ম।
গ) উচ্চারণরীতি অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিবিন্যাস দেখার দরকার:
১। স্পৃষ্ট: অল্পপ্রাণ: ক গ ট ড ত দ প ব
মহাপ্রাণ: খ ঘ ঠ ঢ থ ধ ফ ভ
২। ঘৃষ্ট: অল্পপ্রাণ: চ জ
মহাপ্রাণ: ছ ঝ
৩। নাসিক্য: ঙ ঞ ণ ন ম
পার্শ্বিক: ল
কম্পনজাত: র
তাড়নজাত: অল্পপ্রাণ- ড়, মহাপ্রাণ: ঢ়
৪। উষ্ম: শ ষ স জ ফ ভ হ ঃ
অর্ধস্বর: য়(ওয়)
বি: দ্র: প্রত্যেকটি অল্পপ্রাণ বর্ণের সাথে একটি করে হ+ যুক্ত করলেই মহাপ্রাণ হয়ে যায়।
যেমন: ক(k)+হ(h)= খ(kh), গ(g)+হ(h)= ঘ(gh) ইত্যাদি।
ঘ) এবার বানারীতির বিবেচনার জন্য ‘শ‘ ‘ষ‘ ‘স‘- এর পরিচয় জানার চেষ্টা করি।
শ, ষ, স- এই বর্ণ তিনটিই উষ্ম ধ্বনি। এদের উচ্চারণের সময় জিভ তালু দাঁত সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হয়েও নিঃশ্বাসবায়ূকে কখনো একেবারে রুদ্ধ করে না। এরা তালু, মূর্ধা ও দন্ত স্পর্শ করে ফুসফস থেকে আগত বাতাসকে সংকীর্ণ পথ দিয়ে বের করে দেয়। স্পর্শ স্থান অনুসারে তাই এ ধ্বনিগুলোর নাম যথাক্রমে তালব্য শ, মূর্ধন্য ষ ও দন্ত্য স। এই বর্ণ তিনটির ধ্বনির উচ্চারণ শিসের মতো বলে এদের শিস ধ্বনিও বলা হয়।
শ, ষ, স – এর উচ্চারণ বাংলায় একই রকম- ইংরেজির ‘Sh‘-এর মতো। প্রাচীনকালে এদের উচ্চারণ ছিল যথাক্রমে ইংরেজি sh, kh এবং s- এর অনুরূপ। বর্তমানে বাংলায় কেবল /ত, থ ন, র, ল/এর পূর্বে শ, স আসলে স-এর ধ্বনি শোনা যায়। যেমন: স্ত্রী= stri (shtriনয়), স্থান= sthan (shtran নয়), স্নান= snan( shnanনয়) শ্লীল= slil(shlil নয়) .
ঙ) মূলত এই তিনটি বর্ণ একই বর্ণ। পণ্ডিৎগণ দেখলেন যে, এই তিনটি ধ্বনি পরবর্তী বর্ণের উচ্চারণকে অনুসরণ করতে গিয়ে তিনভাবে তিনস্থানে উচ্চারিত হয়। তাই তারা তিনটি উচ্চারণের পৃথিকিকরণের জন্য তিনটি বর্ণ বা আকার দান করে আমাদের মহা উপকার করেছেন। আমরা সে সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত হলেই বুঝতে পারবো বাংলা একাডেমি আমাদের মধুর কথা বলে বিষ পান করাচ্ছে।
চলবে-

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন