ইদ ও ঈদ বানান নিয়ে বিতর্ক/ ড. মোহাম্মদ আমীন


(সংক্ষেপিত)
বাংলায় ধ্বনিমূলগত দীর্ঘস্বর নেই। হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বরের উচ্চারণ অভিন্ন। তাছাড়া এক ভাষার শব্দকে অন্য ভাষার বর্ণ দিয়ে অবিকল উচ্চারণানুগ শব্দে প্রকাশ করার প্রয়াস হাস্যকর। পৃথিবীর কোনো ভাষাতে এটি সম্ভব নয় এবং ভাষার স্বকীয় মর্যাদা বজায় রাখার জন্য এমনটি করাও হয় না। বিদেশি ভাষার কোনো শব্দ বাংলায় এলে তাকে বাংলা ভাষায় বিদ্যমান বর্ণ-চিহ্ন দিয়ে যতটুক পারা যায় কেবল ততটুকুই অতিথি ভাষার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিপাদন করা হয়। বিদেশি কোনো শব্দকে বাংলায় এনে ওই ভাষার অনুরূপতা বজায় রাখার জন্য নিজ ভাষার স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যরাশিকে বিসর্জন দেওয়া অত্মমর্যাদা বিলিয়ে দেওয়ার তুল্য। বাঙালি ছাড়া আর কেউ, মাতৃভাষায় আগত অতিথি-শব্দকে মর্যাদা দিতে গিয়ে নিজের ভাষার সম্মান ও চরিত্র বিসর্জন দিয়ে দেয় না। মাতৃভাষার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাষা আর কী হতে পারে! অবশ্য যে দেশের অনেকে, বিয়েশাদিসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের চিঠিপত্রে এখনও ইংরেজি ভাষার ব্যবহারকে মর্যাদাময় গণ্য করেন, সে দেশের মানুষের মাতৃভাষা প্রেম, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, স্বকীয় দ্যোতনা ও আত্মসম্মানবোধ কত ঠুনকো তা সহজে অনুমেয়।
 বাংলায় ‘ঈদ’ বানান সংস্কৃত ভাষার আদল। ‘ইদ’ বানান বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বিকাশ। عيد বানান বাংলা বর্ণে যেভাবে লেখা হোক না, উচ্চারণ হবে অভিন্ন (ইদ)। অনেকে মনে করেন, ‘ঈদ’ শব্দের উচ্চারণ আরবি عيد শব্দের উচ্চারণের মতো। এটি হাস্যকর, ব্যক্তিগত এবং সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচার। কারণ আরবি عيد এর অভিন্ন উচ্চারণময় বানান বাংলায় কোনোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ বাংলায় ধ্বনিমূলগত দীর্ঘস্বর নেই, সংস্কৃত ভাষায় যেমন রয়েছে। তাই ইদ বানান লিখলে যেমন উচ্চারণ হবে ঈদ বানান লিখলেও তেমন উচ্চারণ হবে। স্বরের জন্য উচ্চারণের কোনো পার্থক্য হবে না।
 মানুষ, শব্দকে পদে রূপ দিয়ে বার্তা দেয়, সংলাপ তৈরি করে; শব্দের বিচিত্র রূপের জন্য বহুস্বর polyphony তৈরি হয়। মানুষ, শব্দের ধ্বনিসমূহ (phonemes) উচ্চারণ করেই শব্দকে ধ্বনিত করে; উচ্চারণ করে। মানে এটি ঘটে: Articulatory to Auditory phonetics এর দিকে যেয়ে। তাহলে মানুষ শব্দ উচ্চারণ করে- যার মধ্যে থাকে তার চিন্তা -চেতনা। মানুষ নিজেই ভাষার নিয়মে শব্দ উচ্চারণ করে।
যদি তাই হয়, তাহলে এটি নিশ্চিত যে, রূপতত্ত্বে (morphology) ঈদ রূপটি (morph) বাংলারীতিতে উচ্চারণ হবে ইদ। কারণ বাংলায় দীর্ঘধ্বনির (phoneme) উচ্চারণ নেই। ঈদ উচ্চারণ হবে ইদ। এই ইদ উচ্চারণ হল Allophone। এটাই সঠিক।মানুষ ঠিকভাবেই ইদ উচ্চারণ করছে।  মানুষ subject, বানান object. জনগণ তার নিজের ব্যাকরণে কথা বলে, পরে ব্যাকরণ তৈরি হয়। মানুষ ইদ উচ্চরণ করে প্রকৃত বাংলা ভাষার নিয়মে। ভাষাকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলতে না দিলে সংস্কৃত ভাষার মতো অবস্থা হতে পারে বাংলার। 
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের স্বরবর্ণ অংশের ভূমিকায় মুহম্মদ এনামুল হক লিখেছিলেন, "... আর একটি প্রধান সংস্কার হইল- তদ্ভব, দেশী(দেশি), বিদেশী(বিদেশি) শব্দের বেলায় মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্ম-বাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের শেষে কেবল 'ই' হবে-'ঈ' হবে না, যেমন কাঠবিড়ালি... অথচ এখনও আমরা বাড়ী, গাড়ী,... প্রভৃতির শেষে 'ঈ'-কার দেদার ব্যবহার করিয়া চলিয়াছি।"
সুতরাং, 'ইদ' শব্দটি বাংলা একাডেমির অভিধানে অনেক পূর্ব হতে ছিল। কেউ যদি জীবনে একবারও বাংলা একাডেমির অভিধান না খুলেন, তবে অহেতুক পাণ্ডিত্য  দেখাতে যাওয়া বোকামি ছাড়া আর কী।
অনেকে বলেন ‘ঈদ’ হবে, কারণ দীর্ঘ টান। বাংলায় তো উচ্চারণগত কোনো দীর্ঘস্বর নেই। আরবিতে এক আলিফ, তিন আলিফ এবং চার আলিফ টান রয়েছে। বাংলায় এমন কোনো প্রতীক নেই, যা তিন আলিফ এবং চার আলিফ টান বর্ণনা করে। এমনকি  খোদ IPA(International Phonetic Alphabet) তেও তিন আলিফ এবং চার আলিফ টান নেই।
বাংলা ভাষার শব্দে ব্যবহৃত দীর্ঘস্বরের কাজ অর্থদ্যোতনার ভিন্নতা আনয়ন।উচ্চারণ-দ্যোতনায়  এর কোনো ভূমিকা নেই। যেমন : দিন/দীন, কুল/কূল, চির/চীর শব্দজোড়ের উচ্চারণ অভিন্ন। তাই ইভ ও ঈভ, পির ও পীর, ঈশ ও ইস, নিচ ও নীচ কিংবা মুল ও মূল, কুল ও কূল, দুর ও দূর প্রভৃতি শব্দে অর্থগত পার্থক্য থাকলেও উচ্চারণগত কোনো পার্থক্য নেই। তাই বাংলা বানানে সমতা আনয়নের জন্য এবং বাংলা ভাষার স্বকীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আদর্শিক নির্দেশনা আবশ্যক। এ নির্দেশনায় উচ্চারণগত কোনো সমস্যা স্বাভাবিক কারণে আসার কথা নয়। - - - বিশেষ কারণে       নিপাতনে সিদ্ধ কথাটি খুব সীমিত মাত্রায় বিবেচনা করা যায়।তবে এটি করতে গিয়ে সমতা    বিধানের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করা সমীচীন হবে না।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন