লক্ষ্মীতে ম কেন? / Subhasis Chirakalyan Patra


লক্ষ্মী বানানে ম আসে কেন ?
লক্ষ্মী বানানে ম আসে কেন ? প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয়। অনেকে কারণটি বুঝতে পারেন না এবং লক্ষ্মী বানান 'লক্ষী' লিখে যদি কাজ চলে যায় তাহলে আর লক্ষ্মী লিখতে চান না। বিষয়টি আমি যতটুকু বুঝেছি তা সংক্ষেপে বলব। সেই সঙ্গে লক্ষ্মী শব্দটির ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থও বলব। শব্দের বানান ও অর্থ অঙ্গাঙ্গি জড়িত।
প্রথমে মৎপ্রণীত পদ্যাভিধান 'বর্ণসঙ্গীত' থেকে লক্ষ্মী শব্দের সূত্র বলছি :
লক্ষ্ ধাতুতে ঈ যোগ করিলে লক্ষ্মী হইয়া যায়,নীতিমানদের লক্ষ করে যে লক্ষ্মী বলিব তায়।অসুরেরা যবে নীতিহীন হল লক্ষ্মী তাদের ছেড়ে,দেবতার ঘরে উড়িয়া গেলেন পেচকের পিঠে চড়ে।প্রথমে লক্ষ্মী শব্দের অর্থ বলি। লক্ষ্মী শব্দটি আসে লক্ষ্ ধাতুর সঙ্গে ঈ প্রত্যয় যুক্ত করে। এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল 'যিনি নীতিমানদের লক্ষ করেন'। অমরকোষের বিখ্যাত টীকাকার শ্রীচন্দ্রমোহন তর্করত্ন মহাশয় লক্ষ্মী শব্দের এই ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ করেছেন।
লক্ষ ধাতুর সঙ্গে ঈ প্রত্যয়টি যুক্ত হওযার সময় একটি বর্ণের (এখানে ম-এর) আগম হয়। ব্যাকরণে একে বর্ণাগম বলে। এই কারণেই লক্ষ্মী বানান 'লক্ষী' লেখা চলবে না। লক্ষ্মী শব্দে এই ম বর্ণটির যথেষ্ট তাৎপর্য্য আছে বলে আমার মনে হয়। ম বর্ণে মিতকরণ বা সীমায়ন ক্রিয়া হয় (এই ব্যাপারে খান-চক্রবর্তীর 'সরল শব্দার্থকোষ' দ্রষ্টব্য)। পরিমিতি না থাকলে লক্ষ্মী হয় না, কুবের হয়। কুবেরের পুঁজি বেড়ে বেড়ে সে কুৎসিত হয়ে যায়। কুবের মানে যার বের বা শরীর কু বা কুৎসিৎ। আজকের দিনেও বহু ধনকুবেরের অবস্থা ওইরকমই হয়। লক্ষ্মী কিন্তু শ্রীময়ী। লক্ষ্মীপুঁজি কিন্তু থামতে জানে (সীমায়িত হয়) এবং তা শ্রীময়ী ও কল্যাণময়ী হয়।
লক্ষ্মীর পাঁচালিতে আছে যে লক্ষ্মী আগে অসুরদের ঘরেই ছিলেন। অসুরেরা নীতিহীন হলে তবেই তিনি দেবতাদের কাছে চলে যান। কেন লক্ষ্মী অসুরদের পরিত্যাগ করেছিলেন তার বিস্তারিত কারণ লক্ষ্মীর পাঁচালিতে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, নিকট অতীতে পূর্ব্বতন সোভিয়েত রাশিয়াতেও দেখা গেছে সৌভাগ্যলক্ষ্মী সমাজতান্ত্রিকদের ছেড়ে ধনতান্ত্রিকদের দিকে চলে গিয়েছিলেন। অসুরদের সমাজতন্ত্রের এবং দেবতাদের ধনতন্ত্রের প্রতিভু বলে মনে করলে লক্ষ্মীর অসুরদের ছেড়ে দেবতাদের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের ঘটনাকে তুলনা করা চলে। সোভিয়েত রাশিয়ার সৌভাগ্যলক্ষ্মী কেনে সমাজতান্ত্রিকদের ছেড়ে গিয়েছিল তা অবশ্য রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবেন।
এই রচনার সঙ্গে লক্ষ্মীর যে ছবিটি দেখছেন সেটি শিল্পী ও কবিদের ভাবনার প্রতিফলন এবং তাও খুব যুক্তিপূর্ণ ও সুন্দর। আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা আস্তিকতা ও নাস্তিকতা দুইই বুঝতেন। আধুনিক পাঠকেরা লক্ষ্মীর পাঁচালি থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির পাঠ নিতে পারেন। ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি রপ্ত করতে পারলে সেই কাজ অনেকটাই সহজ হতে পারে।
আধুনিক যুক্তিবাদী পাঠক লক্ষ্মীমূর্ত্তির পূজায় বিশ্বাস নাও করতে পারেন, কিন্তু বাড়ীতে মা-দিদিমারা লক্ষ্মীপূজা করলে তাই নিয়ে ঝগড়া করা অনুচিত বলেই আমি মনে করি। বর্ত্তমান লেখক নিজে মূর্ত্তি পূজায় বিশ্বাস করেন না।
পরিশেষে বলব লক্ষ্মী বানান যেন কখনও 'লক্ষী' না লেখা হয়। আশা করি কেউ এই বিষয়ে দ্বিমত হবেন না।

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

হিসাব আর হিসেবে / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ