নিউটনের ছাত্রীর কী হলো? লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে/ প্রফেসর শাহিদা সুলতানা অনি

স্যার, একটা কথা বলি?প্রকাশনা সংস্থার প্রবীণ প্রুফ রিডার সুনীল বাবুর কণ্ঠ শুনে বই থেকে চোখ তুললাম। চোখ তার জলে ডুবো ডুবো, মুখটা বিষণ্নতায় ছেয়ে। তিনি মাঝে মাঝে বানান সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসেন, কিন্তু এমন করুণ কণ্ঠ কখনও শুনিনি, দেখিনি এমন মলিন চেহারা।ফর্সা লোকটা কেমন জানি পাণ্ডুর হয়ে গেল, কিছুক্ষণ আগেও বেশ উৎফুল্ল দেখেছি। মানুষ খুব কষ্ট পেলে কিংবা মানসিক আঘাত লাগলে এমন করুণ গলায় কথা বলে।কী ব্যাপার সুনীল বাবু? আমি সহানুভূতির গলায় বললাম।একটা কথা বলতে চাইছিলাম স্যার।বলুন।“কথটা রাখবেন তো স্যার?” বলেই তার ডান হাতে থাকা কাগজগুলোর দিকে তাকালেন।হাতে কী? জানতে চাইলাম।নিউটনের ছাত্রী।নিউটনের ছাত্রী মানে আমার লেখা ‘নিউটনের ছাত্রী’ নামের কিশোর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি।কী হয়েছে আপনার?“স্যার”, সুনীল বাবুর গলা আরও করুণ, আরও বিগলিত, “মেয়েটাকে না-মারলে হয় না? কত ভালো মেয়ে স্যার, এমন নিষ্ঠুরতা কি উচিত হবে?”কোন মেয়েকে আমি মারলাম? শঙ্কিত গলায় জানতে চাইলাম।সেলিমা, মানে নিউটনের ছাত্রী উপন্যাসের নায়িকা।আমি হাসি দিয়ে বললাম, কী যে বলেন!আপনি হাসছেন স্যার? এমন একজন ভালো মেয়েকে মেরে হাসতে পারছেন? আমি হলে পারতাম না।হাসি থামিয়ে সুনীল বাবুর দিকে তাকালাম, তার চেহারা আরও বিষণ্ন হয়ে গেছে, প্লিজ স্যার, মেয়েটা আামর হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। তাকে মারবেন না।সম্ভব নয়। আপনি এখন যান, অনেক পাণ্ডুলিপি পড়ে আছে।বিমর্ষ মনে আমার রুম ছাড়লেন সুনীল বাবু, কিন্তু আমার মন ছাড়লেন না। সুনীল বাবুর কথা আমার মনে একই সঙ্গে কষ্ট আর আনন্দ হয়ে কচকচ করছে। কিছুক্ষণ আনমনা থেকে আমার কাজে ডুবে গেলাম।ঘণ্টা খানেক পর আবার এলেন সুনীল বাবু, কী ব্যাপার সুনীল বাবু?স্যার, কোনোভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না?আপনার সমস্যাটা কী?আমি স্যার কাজ করতে পারছি না কষ্টে। এরকম ভালো একটা মেয়েকে যদি মেরে ফেলেন, তাহলে দেশের কী হবে স্যার? নারী জাতির কী হবে স্যার?সে মরে গেছে, আমি কীভাবে বাঁচাব বলুন?কলম আপনার হাতে। ঈশ্বর যা করতে পারেন না একজন লেখক তা করতে পারেন। আপনি তাকে বাঁচিয়ে দিন স্যার, আপনার কলমের জোরে।আমি তাকে আবার হতাশ করলাম। মন খারপ করে বার কয়েক আমার পিছন ফেরে তাকাতে তাকাতে

চলে গেলেন। সন্ধ্যায়, অফিস ছুটির পর আবার এলেন, এবারও তার কথা রাখা সম্ভব হলো না। লেখকগণ মরা মানুষকে জীবিত করতে পারেন, কিন্তু সব মরা মানুষকে জীবিত করতে পারেন না।শ্যামল পালের বড়ো মেয়ে নির্বাচিতা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সে বাবার সঙ্গে অফিসে আসা শুরু করেছে, উদ্দেশ্য কাজ শেখা। শ্যামল দা বললেন, মেয়েটাকে একটা বই দেন, কীভাবে লেখা হয়েছে, কীভাবে এডিট করা হয়, তা একটু দেখুক।আমি সুনীল বাবুর কাছ থেকে নিউটনের ছাত্রীর পাণ্ডুলিপিটা এনে নির্বাচিতাকে দিয়ে বললাম, এটা পড়ো।ছোটো উপন্যাস, শেষ করতে বেশিক্ষণ লাগল না। এসে বলল, আংকেল, সেলিমাকে মারতে পারবেন না।কেন?আমার আব্‌দার। তার মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারব না। এত প্রাণচঞ্চল একটা মেয়েকে আপনি মেরে ফেলবেন, তা কী করে হয়? দেশে কী মায়ামমতা বলে কিছু নেই?সে তো মা, মারা গেছে।আপনার লৈখিক ক্ষমতাবলে বাঁচিয়ে দিন, জল ছলছল চোখে নির্বাচিতা বলল।সরি, মা।মনটাকে অন্ধকার করে চলে গেল নির্বাচিতা। কিছুক্ষণ পর রিং করলেন শ্যামল দা, কী বলেছেন মেয়েকে?মেয়েদের খুব ভয় আমার, কী জানি কী বলতে কী বুঝে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললাম, কী হয়েছে? “এসে বলছি” বলেই শ্যামল দা ইন্টারকম ছেড়ে নির্বাচিতাকে নিয়ে আমার রুমে চলে এলেন।কী ব্যাপার?নির্বাচিতা বলল, আব্বু, আংকেলকে বলো মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিতে।আমি হাসলাম, সঙ্গে শ্যামলদাও, কিন্তু নির্বাচিতার চোখ জলের মাঝে ডুবে গেল।সেলিমাকে কী আমি বাঁচাতে পেরেছি?জানতে হলে পড়ুন, কিশোর উপন্যাস নিউটনের ছাত্রী।প্রকাশক : পুথিনিলয়পাবেন : অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়ের স্টলে, দাম : ১২৫ টাকা।

Comments

  1. কী সৌভাগ্য আমার, আমি বিখ্যাত প্রবীণ প্রুফ রিডার সুনীল বাবুর প্রুফ করা "মানুষখেকো মানুষের খোঁজে" বইটির 3rd প্রুফ রিড করছি এখন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন