মাতৃভাষা মায়ের মতন, অবহেলা ভুলের কারণ / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ
মাতৃভাষা মায়ের মতন, অবহেলা ভুলের কারণ
মাতৃভাষা মায়ের মতন। তাই মাতৃভাষায় ভুল বা অপপ্রয়োগ নিজের মায়ের প্রতি অবহেলার ন্যায় গুরুতর। প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা মাতৃভাষা প্রয়োগে শুদ্ধজ্ঞানে এমন অনেক ভুল করি যা সত্যি লজ্জাকর। অথচ একটু অনুশোচনা জাগে না। ভুলকে
শুদ্ধজ্ঞানে দিব্যি চালিয়ে দেই। এটি নিজের জননীকে না চেনার মত বিব্রতকার। এখানে এমন কিছু শব্দ দেয়া হল, যা আমরা শুদ্ধ ভেবে নিয়ে লিখি; অথচ শুদ্ধ নয়।
মোঃ মানে মোহ্/ দ্রঃ মানে দ্রহ্
মোহাম্মদ/মুহাম্মদ/ ডাক্তার/ডক্টর প্রভৃতি শব্দের সংক্ষেপণে‘ মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ/ দ্রঃ. বিঃদ্রঃ’ প্রভৃতি লেখার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। প্রকৃতপক্ষে বিসর্গ একটি পৃথক (ঃ) বর্ণ; কোন সংক্ষেপচিহ্ন নয়। তাই শব্দ সংক্ষেপনে অযথা অন্য একটি বর্ণের আমদানি অনুচিত। প্রমিত বাংলায় একবিন্দু (.) কে সংক্ষেপণের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই শব্দ সংক্ষেপনে বিসর্গ ব্যবহার করা বিধেয় নয়।
বিসর্গ ব্যবহার করলে ‘মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ/ দ্রঃ/ বিঃ দ্রঃ’ প্রভৃতি শব্দ যথাক্রমে ‘মোহ্/মুহ্/ডাহ্/ডহ্/ দ্রহ্/ বিহ্ দ্রহ্’ ইত্যাদিরূপে উচ্চারিত হবে। এগুলো অর্থহীন। অতএব শব্দ সংক্ষেপনে বিসর্গ পরিহার করুন। লিখুন মো./ মু./ ডা./ ড./ বি./ বি.দ্র. লিখুন।‘মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ/ বিঃ/ বিঃদ্রঃ’ লিখবেন না।
সত্তা/সত্ত্ব/সত্ত্বা
বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানমতে, ১. ‘সত্তা’ শব্দের অর্থ অস্তিত্ব/ স্থিতি/বিদ্যমানতা/বর্তমানতা। ২. সত্ত্ব শব্দের অর্থ স্বত্তা সুতরাং সত্ত্ব = সত্তা =অস্তিত্ব/ স্থিতি/বিদ্যমানতা/ বর্তমানতা।‘সত্ত্ব’ শব্দের আর একটি অর্থ আছে। সেটি হচ্ছে- ফলের রস দ্বারা প্রস্তুত কোন খাদ্যবস্তু। যেমন: আমসত্ত্ব। অনেকে ‘সত্তা/সত্ত্ব’ শব্দের পরিবর্তে স্বত্ত্বা শব্দ লিখে থাকেন।‘সত্ত্বা’ শব্দের অর্থ কী কিংবা আদৌ এমন শব্দ বাংলা ভাষায় আছে কিনা আমার জানা নেই।
প্রকৃতপক্ষে ‘সত্তা’ ও ‘সত্ত্ব’ ভিন্ন অর্থদ্যোতক শব্দ। নিজের অধিকারে কোন কিছু আছে বুঝাতে স্বত্ব হবে। কেননা, স্ব মানে নিজে এবং ত্ব মানে অধিকারে। আর অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা বুঝাতে সৎ+ত্ব= সত্ত্ব । এর দ্বিতীয় অর্থ- প্রকৃতির তিনটি গুণের মধ্যে শেষ্ঠ গুণ। আর তৃতীয় অর্থ হলা- ফলের রস। এর বিশেষ্য হবে-সত্তা। এ আলোচনায় ‘সত্তা’ ও ‘সত্ত্ব’ শব্দের ব্যবহার নিশ্চয় আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। অতএব ‘সত্তা’ ও ‘সত্ত্ব’ ব্যবহারে আর কোন সংশয় থাকার কথা নয়।
নেত্রীবর্গ/নেতৃবর্গ
নেত্রীবর্গ ও নেতৃবর্গ শব্দ দুটি সমোচ্চারিত কিন্তু বানান ও অর্থ ভিন্ন। নেত্রীবর্গ শব্দের অর্থ মহিলা নেতাগণ। অন্যদিকে নেতৃবর্গ শব্দের অর্থ নেতাগণ (পুরুষ-মহিলা সবাই)। তেমনি অভিনেত্রীবর্গ মানে মহিলা অভিনেতাবৃন্দ কিন্তু ও অভিনেতৃবর্গ অর্থ সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রীগণ।
মহাজ্ঞানী/মহা পাপী
‘মহা’ শব্দটি ভাল, উত্তম কিংবা মহান অর্থে ব্যবহৃত হলে সংশ্লিষ্ট পদের সঙ্গে একত্রে সেঁটে বসে। আসলে ভালো জিনিসকে কাছে রাখা উচিত। যেমন: মহানবী, মহাপুরুষ, মহাজ্ঞানী, মহামানব, মহানুভব, মহাপ-িত, মহারাজ প্রভৃতি। ‘মহা’ শব্দটি বিরাট কিংবা প্রচ- কিংবা বিকট অর্থে ব্যবহৃত হলে পৃথক বসে। যেমন: মহা লুচ্চা, মহা পাপী, মহা বোকা, মহা জালিম, মহা দীঘি ইত্যাদি।
কার্যকর/কার্যকরী
কার্যকর শব্দের অর্থ ফলদায়ক বা উপযোগ বা যথার্থ। এ শব্দটির সাথে দীর্ঘ ঈ-কার যুক্ত করা বিধেয় নয়। অকারণে ঈ-কার যুক্ত করা বাহুল্য-দোষ।
ব্যবসা/ব্যবসায়
ব্যবসা শুদ্ধ শব্দ নয়। শুদ্ধ হল ব্যবসায়। তবে অনেকে লিখে থাকেন ব্যবসা। এটি প্রচলিত হলেও অশুদ্ধ। অতএব লিখুন ব্যবসায়। ব্যবসা লিখবেন না।
Definition অর্থ সংজ্ঞা নয় /অভিধানে তেমন কয়:
Definition শব্দের বাংলা অর্থ হিসেবে ‘সংজ্ঞা’ লেখার বহুল প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সর্বত্র ইংরেজি ‘Definition ’ শব্দের বাংলা অর্থ করা হচ্ছে ‘সংজ্ঞা’। এটি শুধু ভুল নয়, মারাত্মক ভুল। প্রশ্নপত্রে লেখা হয় সংজ্ঞা (Definition ) দাও। কিন্তু Definition শব্দের বাংলা অর্থ সংজ্ঞা নয়, সংজ্ঞার্থ। সংজ্ঞা শব্দের অর্থ হল ‘নাম’ বা ‘পরিভাষা’। সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য অর্থ নামবাচক বিশেষ্য। বস্তুত অপাদান কারক, অপনিহিতি, বিপ্রকর্ষ, অবয়ীভাব সমাস প্রভৃতি হচ্ছে সংজ্ঞা বা পরিভাষা। সুতরাং ‘অপদান কারকের সংজ্ঞা দাও’ বাক্যের অর্থ হবে অপদান কারকের ‘নাম’ দাও বা অপদান কারকের ‘পরিভাষা’ দাও। এটি কোন অর্থপূর্ণ বাক্য হতে পারে না। বলা যেতে পারে অপদান কারকের ‘সংজ্ঞার্থ’ দাও কিংবা অপদান কারকের ‘ব্যাখ্যা ’দাও। ইংরেজি Definition শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সংজ্ঞার্থ। অতএব লিখুন ‘সংজ্ঞার্থ’ দাও; ভুলেও ‘সংজ্ঞা’ দাও লিখবেন না। অভিধান বা ব্যাকরণের কোথাও উবভরহরঃরড়হ শব্দের অর্থ হিসেবে সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি।
বেশি/বেশী
‘বেশি’ ও ‘বেশী’ দুটি ভিন্ন অর্থদ্যোতক শব্দ। উচ্চারণ অভিন্ন হলেও বানান ও অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু অনেকে শব্দ দুটির অর্থকে গুলিয়ে ফেলেন ‘বেশি’ শব্দের অর্থ অনেক বা খুব। অন্যদিকে ‘বেশী’ শব্দের অর্থ বেশধারী। সুতরাং খুব বা অনেক বুঝাতে ‘বেশি’ লিখুন।প্রয়োগ: (১) বেশি সম্পদ মানুষকে অবিবেচক করে দেয়।(২) পাগল-বেশী লোকটা আসলে একজন গোয়েন্দা।
প্রতীক্ষা আর অপেক্ষার পার্থক্য
প্রথমে বলে রাখি সাধারণত ‘প্রতীক্ষা’ ও ‘অপেক্ষা’ উভয় শব্দের অর্থগত কোন পার্থক্য নেই। অপেক্ষা অর্থ প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষা অর্থ অপেক্ষা। সহজভাষায় উভয় শব্দের পার্থক্য এত কম যে, অপেক্ষার স্থলে প্রতীক্ষা ও প্রতীক্ষার স্থলে অপেক্ষা লেখা যায়। প্রতীক্ষার চেয়ে অপেক্ষার ব্যবহার ব্যাপক। শব্দদ্বয়ের পার্থক্য এত সুক্ষ্ণ যে, গভীরভাবে নীরিক্ষণ না করলে পার্থক্য অনুধাবন করা অসম্ভব। উদাহরণ: অপেক্ষার যন্ত্রণা প্রতীক্ষার প্রহর/ প্রতীক্ষার অবসান অপেক্ষার নহর।
সুক্ষ্ম পার্থক্যটি কী তা আরও বিশদ করা যায়: প্রতীক্ষা অর্থে যা ঘটতে পারে সে বিষয়ের জন্য অপেক্ষা করা। যেমন: অধীরচিত্তে বসিয়া যুবক প্রেয়সীর প্রতীক্ষায়। প্রতীক্ষার সময় সাধারণত অপেক্ষার সময় থেকে দীর্ঘতর। যেমন: তোমার জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। প্রতীক্ষার অবসান হয় না গো সখি। ধৈর্য, নির্ভরতা, কারণ, শঙ্কা প্রভৃতি অর্থেও অপেক্ষা ব্যবহৃত হয়। যেমন: অপেক্ষা সফলতার সেতু। বৃষ্টির অপেক্ষায় কৃষিকাজ বন্ধ। অপেক্ষার যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ।
কীভাবে/কিভাবে কি ভাবে/ কী ভাবে
অনেকে ‘কী উপায়ে’ শব্দগুচ্ছের অর্থ প্রকাশের জন্য লিখেন- কী ভাবে? এটি ভুল। ‘কী ভাবে’ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘কী চিন্তা করে’। অন্যদিকে ‘কী উপায়ে’ শব্দগুচ্ছের সমার্থক শব্দ হল ‘কীভাবে’। অতএব ‘কী উপায়ে’ অর্থ প্রকাশে লিখুন ‘কীভাবে’, কী ভাবে লিখবেন না। কিভাবে শব্দ এবং কি ভাবে শব্দগুচ্ছ ভুল। কারণ দুটির কোনটির উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। শুদ্ধরূপ হচ্ছে কীভাবে এবং কী ভাবে।
‘আগামী’ ও ‘গত’ ফাঁক রাখা ব্রত
‘আগামী’ ও ‘গত’ শব্দ দুটির পরবর্তী শব্দ থেকে ফাঁক রেখে বসবে। অনেকে শব্দ দুটি সেঁটে বসিয়ে দেন। এমনটি করবেন না। আগামী ও গত শব্দের সাথে যুক্ত শব্দ বা শব্দাংশ ফাঁক রেখে বসাবেন। যেমন- আগামী কাল, আগামী বছর, আগামী মাস, আগামী শতক, গত দিন, গত মাস, গত কাল, গত বার, গত যুগ, গত শতক আগামী মৌসুম, আগামী সন ইত্যাদি।
জেল প্রশাসক নয়, জেলাপ্রশসক
আমরা লিখি জেলা প্রশাসক। এটি প্রচলিত ভুল। বাংলা ব্যাকরণমতে ‘জেলা প্রশাসক’ বিধেয় নয়। কারণ সমাসবদ্ধ পদ পরস্পর সেঁটে বসে। ফাঁক রেখে লিখলে লিখতে হবে জেলার প্রশাসক। কিন্তু জেলা প্রশসক লেখা ব্যাকরণ সম্মত নয়। সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে জেলা শব্দের র-বিভক্তির ষষ্ঠী তৎপুরষ বিবেচনায় শব্দ দুটি যুক্ত হয়ে একসাথে বসবে। যেমন: জেলার প্রশাসক> জেলাপ্রশাসক।
বাঙালি/ বাঙালী/বাঙ্গালী/ বাঙ্গালি
বাঙালি/ বাঙালী/ বাঙ্গালী/ বাঙ্গালি চার রকম বানান দেখা যায়। একটা অখ- জাতি হয়েও নিজের বানানটা এখনও অদ্বিতীয় করে তোলা গেল না। এরজন্য কে দায়ী সে প্রশ্নে না গিয়ে বলা যায়, এটি আমাদের চরম লজ্জা। যাই হোক, শুদ্ধ একাধিক হতে পারে না। সুতরাং দেখা যাক, প্রমিত বানানের নিয়মানুযায়ী কোন্ বানানটি শুদ্ধ। এখানে প্রমিত বানান রীতি অনুযায়ী লিখুন বাঙালি (বাঙ+ আলি= বাঙালি)। অন্যগুলো বাদ দিন।
শান্ত/সান্ত
‘শান্ত’ শব্দের অর্থ শান্তিযুক্ত/শমপ্রাপ্ত/ উৎকণ্ঠাশূন্য। উদাহরণ: শান্ত মন আনন্দের উৎস। ‘সান্ত’ শব্দের অর্থ অন্তবিশিষ্ট, সীমাবদ্ধ, সসীম। উদাহরণ: বিশেষ আদেশ দ্বারা রাষ্ট্রপতির যাতায়াত সান্ত করে দেয়া হল। উদাহরণ: শান্ত সান্ত জায়গায় শান্ত হয়ে বসে আছে।
ভাল/ভালো
‘ভাল’এর ইংরেজি প্রতিশব্দ forehead, brow, fate ইত্যাদি। ‘ভালো/ ভাল’ শব্দদ্বয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ good, fair, excellent ভালো শব্দটি ‘ভাল’ হিসেবেও লেখা হয়। অভিধানেও অমনটি দ্বিতীয় ঘরে শুদ্ধ দেখানো হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি বানানে পার্থক্য আছে সেহেতু গুড বলতে ভালো লেখাই বিধেয়।
কাব্য ও কাব্যগ্রন্থ
‘কাব্য’ মানে কবিতার বই। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ একটি কাব্য। কাব্যগ্রন্থ নয়। মধুসূদনের ‘মেধনাধ বধ’ একটি কাব্য, কাব্যগ্রন্থ নয়। অতএব লিখুন ‘কাব্য’ বা ‘কবিতার বই’ বা ‘কবিতার গ্রন্থ’। ‘কাব্যগ্রন্থ’ লিখবেন না।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
Judicial Magistrate শব্দদ্বয়কে বাংলায় লেখা হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। যার বাংলা প্রতিশব্দ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট। Judicial Magistrate শব্দদ্বয়কে বাংলায় জুডিশিয়াল লেখা শুধু অসুন্দর নয়, অশোভনও বটে। ‘শিয়াল’ শোভনীয় শব্দ নয়। লিখুন জুডিশ্যল/জুডিশ্যাল ম্যাজিস্ট্রেট।
রুগ্ণ হবে রুগ্ন নয়
অসুস্থ বা পীড়িত অর্থে অনেকে ‘রুগ্ন’ বানানের উদ্ভট একটি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। অথচ ‘রুগ্ন’ বানানের কোন শব্দ বাংলা অভিধানে নেই। অসুস্থ বা পীড়িত শব্দের অর্থ রুগ্ণ। অতএব অসুস্থ বা পীড়িত অর্থে লিখুন রুগ্ণ। ‘রুগ্ন’ লিখলে বানানে রুগ্ণ পরিচয়টা প্রকট হয়ে উঠবে।
মাতৃভাষা মায়ের মতন। তাই মাতৃভাষায় ভুল বা অপপ্রয়োগ নিজের মায়ের প্রতি অবহেলার ন্যায় গুরুতর। প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা মাতৃভাষা প্রয়োগে শুদ্ধজ্ঞানে এমন অনেক ভুল করি যা সত্যি লজ্জাকর। অথচ একটু অনুশোচনা জাগে না। ভুলকে
শুদ্ধজ্ঞানে দিব্যি চালিয়ে দেই। এটি নিজের জননীকে না চেনার মত বিব্রতকার। এখানে এমন কিছু শব্দ দেয়া হল, যা আমরা শুদ্ধ ভেবে নিয়ে লিখি; অথচ শুদ্ধ নয়।
মোঃ মানে মোহ্/ দ্রঃ মানে দ্রহ্
মোহাম্মদ/মুহাম্মদ/ ডাক্তার/ডক্টর প্রভৃতি শব্দের সংক্ষেপণে‘ মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ/ দ্রঃ. বিঃদ্রঃ’ প্রভৃতি লেখার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। প্রকৃতপক্ষে বিসর্গ একটি পৃথক (ঃ) বর্ণ; কোন সংক্ষেপচিহ্ন নয়। তাই শব্দ সংক্ষেপনে অযথা অন্য একটি বর্ণের আমদানি অনুচিত। প্রমিত বাংলায় একবিন্দু (.) কে সংক্ষেপণের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই শব্দ সংক্ষেপনে বিসর্গ ব্যবহার করা বিধেয় নয়।
বিসর্গ ব্যবহার করলে ‘মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ/ দ্রঃ/ বিঃ দ্রঃ’ প্রভৃতি শব্দ যথাক্রমে ‘মোহ্/মুহ্/ডাহ্/ডহ্/ দ্রহ্/ বিহ্ দ্রহ্’ ইত্যাদিরূপে উচ্চারিত হবে। এগুলো অর্থহীন। অতএব শব্দ সংক্ষেপনে বিসর্গ পরিহার করুন। লিখুন মো./ মু./ ডা./ ড./ বি./ বি.দ্র. লিখুন।‘মোঃ / মুঃ / ডাঃ / ডঃ/ বিঃ/ বিঃদ্রঃ’ লিখবেন না।
সত্তা/সত্ত্ব/সত্ত্বা
বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানমতে, ১. ‘সত্তা’ শব্দের অর্থ অস্তিত্ব/ স্থিতি/বিদ্যমানতা/বর্তমানতা। ২. সত্ত্ব শব্দের অর্থ স্বত্তা সুতরাং সত্ত্ব = সত্তা =অস্তিত্ব/ স্থিতি/বিদ্যমানতা/ বর্তমানতা।‘সত্ত্ব’ শব্দের আর একটি অর্থ আছে। সেটি হচ্ছে- ফলের রস দ্বারা প্রস্তুত কোন খাদ্যবস্তু। যেমন: আমসত্ত্ব। অনেকে ‘সত্তা/সত্ত্ব’ শব্দের পরিবর্তে স্বত্ত্বা শব্দ লিখে থাকেন।‘সত্ত্বা’ শব্দের অর্থ কী কিংবা আদৌ এমন শব্দ বাংলা ভাষায় আছে কিনা আমার জানা নেই।
প্রকৃতপক্ষে ‘সত্তা’ ও ‘সত্ত্ব’ ভিন্ন অর্থদ্যোতক শব্দ। নিজের অধিকারে কোন কিছু আছে বুঝাতে স্বত্ব হবে। কেননা, স্ব মানে নিজে এবং ত্ব মানে অধিকারে। আর অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা বুঝাতে সৎ+ত্ব= সত্ত্ব । এর দ্বিতীয় অর্থ- প্রকৃতির তিনটি গুণের মধ্যে শেষ্ঠ গুণ। আর তৃতীয় অর্থ হলা- ফলের রস। এর বিশেষ্য হবে-সত্তা। এ আলোচনায় ‘সত্তা’ ও ‘সত্ত্ব’ শব্দের ব্যবহার নিশ্চয় আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। অতএব ‘সত্তা’ ও ‘সত্ত্ব’ ব্যবহারে আর কোন সংশয় থাকার কথা নয়।
নেত্রীবর্গ/নেতৃবর্গ
নেত্রীবর্গ ও নেতৃবর্গ শব্দ দুটি সমোচ্চারিত কিন্তু বানান ও অর্থ ভিন্ন। নেত্রীবর্গ শব্দের অর্থ মহিলা নেতাগণ। অন্যদিকে নেতৃবর্গ শব্দের অর্থ নেতাগণ (পুরুষ-মহিলা সবাই)। তেমনি অভিনেত্রীবর্গ মানে মহিলা অভিনেতাবৃন্দ কিন্তু ও অভিনেতৃবর্গ অর্থ সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রীগণ।
মহাজ্ঞানী/মহা পাপী
‘মহা’ শব্দটি ভাল, উত্তম কিংবা মহান অর্থে ব্যবহৃত হলে সংশ্লিষ্ট পদের সঙ্গে একত্রে সেঁটে বসে। আসলে ভালো জিনিসকে কাছে রাখা উচিত। যেমন: মহানবী, মহাপুরুষ, মহাজ্ঞানী, মহামানব, মহানুভব, মহাপ-িত, মহারাজ প্রভৃতি। ‘মহা’ শব্দটি বিরাট কিংবা প্রচ- কিংবা বিকট অর্থে ব্যবহৃত হলে পৃথক বসে। যেমন: মহা লুচ্চা, মহা পাপী, মহা বোকা, মহা জালিম, মহা দীঘি ইত্যাদি।
কার্যকর/কার্যকরী
কার্যকর শব্দের অর্থ ফলদায়ক বা উপযোগ বা যথার্থ। এ শব্দটির সাথে দীর্ঘ ঈ-কার যুক্ত করা বিধেয় নয়। অকারণে ঈ-কার যুক্ত করা বাহুল্য-দোষ।
ব্যবসা/ব্যবসায়
ব্যবসা শুদ্ধ শব্দ নয়। শুদ্ধ হল ব্যবসায়। তবে অনেকে লিখে থাকেন ব্যবসা। এটি প্রচলিত হলেও অশুদ্ধ। অতএব লিখুন ব্যবসায়। ব্যবসা লিখবেন না।
Definition অর্থ সংজ্ঞা নয় /অভিধানে তেমন কয়:
Definition শব্দের বাংলা অর্থ হিসেবে ‘সংজ্ঞা’ লেখার বহুল প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সর্বত্র ইংরেজি ‘Definition ’ শব্দের বাংলা অর্থ করা হচ্ছে ‘সংজ্ঞা’। এটি শুধু ভুল নয়, মারাত্মক ভুল। প্রশ্নপত্রে লেখা হয় সংজ্ঞা (Definition ) দাও। কিন্তু Definition শব্দের বাংলা অর্থ সংজ্ঞা নয়, সংজ্ঞার্থ। সংজ্ঞা শব্দের অর্থ হল ‘নাম’ বা ‘পরিভাষা’। সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য অর্থ নামবাচক বিশেষ্য। বস্তুত অপাদান কারক, অপনিহিতি, বিপ্রকর্ষ, অবয়ীভাব সমাস প্রভৃতি হচ্ছে সংজ্ঞা বা পরিভাষা। সুতরাং ‘অপদান কারকের সংজ্ঞা দাও’ বাক্যের অর্থ হবে অপদান কারকের ‘নাম’ দাও বা অপদান কারকের ‘পরিভাষা’ দাও। এটি কোন অর্থপূর্ণ বাক্য হতে পারে না। বলা যেতে পারে অপদান কারকের ‘সংজ্ঞার্থ’ দাও কিংবা অপদান কারকের ‘ব্যাখ্যা ’দাও। ইংরেজি Definition শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ সংজ্ঞার্থ। অতএব লিখুন ‘সংজ্ঞার্থ’ দাও; ভুলেও ‘সংজ্ঞা’ দাও লিখবেন না। অভিধান বা ব্যাকরণের কোথাও উবভরহরঃরড়হ শব্দের অর্থ হিসেবে সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি।
বেশি/বেশী
‘বেশি’ ও ‘বেশী’ দুটি ভিন্ন অর্থদ্যোতক শব্দ। উচ্চারণ অভিন্ন হলেও বানান ও অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু অনেকে শব্দ দুটির অর্থকে গুলিয়ে ফেলেন ‘বেশি’ শব্দের অর্থ অনেক বা খুব। অন্যদিকে ‘বেশী’ শব্দের অর্থ বেশধারী। সুতরাং খুব বা অনেক বুঝাতে ‘বেশি’ লিখুন।প্রয়োগ: (১) বেশি সম্পদ মানুষকে অবিবেচক করে দেয়।(২) পাগল-বেশী লোকটা আসলে একজন গোয়েন্দা।
প্রতীক্ষা আর অপেক্ষার পার্থক্য
প্রথমে বলে রাখি সাধারণত ‘প্রতীক্ষা’ ও ‘অপেক্ষা’ উভয় শব্দের অর্থগত কোন পার্থক্য নেই। অপেক্ষা অর্থ প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষা অর্থ অপেক্ষা। সহজভাষায় উভয় শব্দের পার্থক্য এত কম যে, অপেক্ষার স্থলে প্রতীক্ষা ও প্রতীক্ষার স্থলে অপেক্ষা লেখা যায়। প্রতীক্ষার চেয়ে অপেক্ষার ব্যবহার ব্যাপক। শব্দদ্বয়ের পার্থক্য এত সুক্ষ্ণ যে, গভীরভাবে নীরিক্ষণ না করলে পার্থক্য অনুধাবন করা অসম্ভব। উদাহরণ: অপেক্ষার যন্ত্রণা প্রতীক্ষার প্রহর/ প্রতীক্ষার অবসান অপেক্ষার নহর।
সুক্ষ্ম পার্থক্যটি কী তা আরও বিশদ করা যায়: প্রতীক্ষা অর্থে যা ঘটতে পারে সে বিষয়ের জন্য অপেক্ষা করা। যেমন: অধীরচিত্তে বসিয়া যুবক প্রেয়সীর প্রতীক্ষায়। প্রতীক্ষার সময় সাধারণত অপেক্ষার সময় থেকে দীর্ঘতর। যেমন: তোমার জন্য দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। প্রতীক্ষার অবসান হয় না গো সখি। ধৈর্য, নির্ভরতা, কারণ, শঙ্কা প্রভৃতি অর্থেও অপেক্ষা ব্যবহৃত হয়। যেমন: অপেক্ষা সফলতার সেতু। বৃষ্টির অপেক্ষায় কৃষিকাজ বন্ধ। অপেক্ষার যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ।
কীভাবে/কিভাবে কি ভাবে/ কী ভাবে
অনেকে ‘কী উপায়ে’ শব্দগুচ্ছের অর্থ প্রকাশের জন্য লিখেন- কী ভাবে? এটি ভুল। ‘কী ভাবে’ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘কী চিন্তা করে’। অন্যদিকে ‘কী উপায়ে’ শব্দগুচ্ছের সমার্থক শব্দ হল ‘কীভাবে’। অতএব ‘কী উপায়ে’ অর্থ প্রকাশে লিখুন ‘কীভাবে’, কী ভাবে লিখবেন না। কিভাবে শব্দ এবং কি ভাবে শব্দগুচ্ছ ভুল। কারণ দুটির কোনটির উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। শুদ্ধরূপ হচ্ছে কীভাবে এবং কী ভাবে।
‘আগামী’ ও ‘গত’ ফাঁক রাখা ব্রত
‘আগামী’ ও ‘গত’ শব্দ দুটির পরবর্তী শব্দ থেকে ফাঁক রেখে বসবে। অনেকে শব্দ দুটি সেঁটে বসিয়ে দেন। এমনটি করবেন না। আগামী ও গত শব্দের সাথে যুক্ত শব্দ বা শব্দাংশ ফাঁক রেখে বসাবেন। যেমন- আগামী কাল, আগামী বছর, আগামী মাস, আগামী শতক, গত দিন, গত মাস, গত কাল, গত বার, গত যুগ, গত শতক আগামী মৌসুম, আগামী সন ইত্যাদি।
জেল প্রশাসক নয়, জেলাপ্রশসক
আমরা লিখি জেলা প্রশাসক। এটি প্রচলিত ভুল। বাংলা ব্যাকরণমতে ‘জেলা প্রশাসক’ বিধেয় নয়। কারণ সমাসবদ্ধ পদ পরস্পর সেঁটে বসে। ফাঁক রেখে লিখলে লিখতে হবে জেলার প্রশাসক। কিন্তু জেলা প্রশসক লেখা ব্যাকরণ সম্মত নয়। সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে জেলা শব্দের র-বিভক্তির ষষ্ঠী তৎপুরষ বিবেচনায় শব্দ দুটি যুক্ত হয়ে একসাথে বসবে। যেমন: জেলার প্রশাসক> জেলাপ্রশাসক।
বাঙালি/ বাঙালী/বাঙ্গালী/ বাঙ্গালি
বাঙালি/ বাঙালী/ বাঙ্গালী/ বাঙ্গালি চার রকম বানান দেখা যায়। একটা অখ- জাতি হয়েও নিজের বানানটা এখনও অদ্বিতীয় করে তোলা গেল না। এরজন্য কে দায়ী সে প্রশ্নে না গিয়ে বলা যায়, এটি আমাদের চরম লজ্জা। যাই হোক, শুদ্ধ একাধিক হতে পারে না। সুতরাং দেখা যাক, প্রমিত বানানের নিয়মানুযায়ী কোন্ বানানটি শুদ্ধ। এখানে প্রমিত বানান রীতি অনুযায়ী লিখুন বাঙালি (বাঙ+ আলি= বাঙালি)। অন্যগুলো বাদ দিন।
শান্ত/সান্ত
‘শান্ত’ শব্দের অর্থ শান্তিযুক্ত/শমপ্রাপ্ত/ উৎকণ্ঠাশূন্য। উদাহরণ: শান্ত মন আনন্দের উৎস। ‘সান্ত’ শব্দের অর্থ অন্তবিশিষ্ট, সীমাবদ্ধ, সসীম। উদাহরণ: বিশেষ আদেশ দ্বারা রাষ্ট্রপতির যাতায়াত সান্ত করে দেয়া হল। উদাহরণ: শান্ত সান্ত জায়গায় শান্ত হয়ে বসে আছে।
ভাল/ভালো
‘ভাল’এর ইংরেজি প্রতিশব্দ forehead, brow, fate ইত্যাদি। ‘ভালো/ ভাল’ শব্দদ্বয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ good, fair, excellent ভালো শব্দটি ‘ভাল’ হিসেবেও লেখা হয়। অভিধানেও অমনটি দ্বিতীয় ঘরে শুদ্ধ দেখানো হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি বানানে পার্থক্য আছে সেহেতু গুড বলতে ভালো লেখাই বিধেয়।
কাব্য ও কাব্যগ্রন্থ
‘কাব্য’ মানে কবিতার বই। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ একটি কাব্য। কাব্যগ্রন্থ নয়। মধুসূদনের ‘মেধনাধ বধ’ একটি কাব্য, কাব্যগ্রন্থ নয়। অতএব লিখুন ‘কাব্য’ বা ‘কবিতার বই’ বা ‘কবিতার গ্রন্থ’। ‘কাব্যগ্রন্থ’ লিখবেন না।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
Judicial Magistrate শব্দদ্বয়কে বাংলায় লেখা হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। যার বাংলা প্রতিশব্দ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট। Judicial Magistrate শব্দদ্বয়কে বাংলায় জুডিশিয়াল লেখা শুধু অসুন্দর নয়, অশোভনও বটে। ‘শিয়াল’ শোভনীয় শব্দ নয়। লিখুন জুডিশ্যল/জুডিশ্যাল ম্যাজিস্ট্রেট।
রুগ্ণ হবে রুগ্ন নয়
অসুস্থ বা পীড়িত অর্থে অনেকে ‘রুগ্ন’ বানানের উদ্ভট একটি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। অথচ ‘রুগ্ন’ বানানের কোন শব্দ বাংলা অভিধানে নেই। অসুস্থ বা পীড়িত শব্দের অর্থ রুগ্ণ। অতএব অসুস্থ বা পীড়িত অর্থে লিখুন রুগ্ণ। ‘রুগ্ন’ লিখলে বানানে রুগ্ণ পরিচয়টা প্রকট হয়ে উঠবে।
Very good
ReplyDelete