ণত্ব বিধান / ড. মোহাম্মদ আমীন

বর্ণচিহ্ন ভিন্ন হলেও বাংলা ভাষায় মূর্ধন্য-ণ ও দন্ত্য-ন এর উচ্চারণ অভিন্ন। উচ্চারণ অভিন্ন বলে বানানে দন্ত্য-ন ও মূর্ধন্য-ণ প্রয়োগে ভুল দেখা যায়। কিন্তু তৎসম শব্দে বানানে কোথাও /মূর্ধন্য-ণ/ আবার কোথাও /দন্ত্য-ন/ বসে। উল্লেখ্য, বাংলায় শুধু তৎসম শব্দে মূর্ধন্য-ণ বজায় আছে। তদ্ভব, অর্ধতৎসম, দেশি ও বিদেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ণ নেই।
তৎসম শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ণ প্রয়োগের বিশেষ বিধান রয়েছে। এ বিধানকে ণত্ব-বিধান বলে। বানান ভুল রোধে এ বিধানটি জানা আবশ্যক। নিচে ণত্ব-বিধানের বিধিগুলো দেয়া হল।
১. যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের পূর্বে মূর্ধন্য-ণ:

ট-বর্গে যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলোর পূর্বে মূর্ধন্য-ণ বসে। অর্থাৎ যুক্তব্যঞ্জনে /ট ঠ ড ঢ ণ/ বর্ণসমূহের পূর্ববর্তী /দন্ত্য-ন/ বর্ণটি পরিবর্তিত হয়ে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যথা:

ণ্ট (ণ+ট) : কণ্টক, ঘণ্ট, ঘণ্টা, নির্ঘণ্ট, নিষ্কণ্টক, বণ্টন;
ণ্ঠ (ণ+ঠ) : অবগুণ্ঠন, উৎকণ্ঠা, কণ্ঠ, কুণ্ঠা, লণ্ঠন, লুণ্ঠন;
ণ্ড (ণ+ড): কুণ্ডলী, কাণ্ড, খণ্ড, গণ্ডার, গণ্ডি, ঠাণ্ডা, দণ্ড, পণ্ডিত, ষণ্ড, ষণ্ডা, মণ্ডলী, প্রকাণ্ড, দণ্ড ভণ্ড;
ণ্ঢ (ণ+ ঢ): ঢুণ্ঢি, ঢেণ্ঢন;
ণ্ন (ণ+ন) : অক্ষুণ্ন, ক্ষুণ্ন, বিষণ্ন;
মজা: (ক) ‘ক্ষুণ্ন’ ও ‘ক্ষুন্নিবৃত্তি’ শব্দদ্বয় লক্ষ্য করুন। ‘ক্ষুণ্ন’ শব্দের বানানে /মূর্ধন্য-ণ ফলা/ বসেছে কিন্তু ‘ক্ষুন্নিবৃত্তি’ শব্দের বানানে /দন্ত্য-ন/ এর দ্বিত্ব হয়েছে। ক্ষুন্নিবৃত্তি (ক্ষুৎ + নিবৃত্তি); এরূপ আর একটি শব্দ ক্ষুন্নিবারণ (ক্ষুৎ + নিবারণ)। শব্দদ্বয়ে দন্ত্য-ন; কারণ এরা সন্ধিজাত শব্দ।
(খ) বিদেশাগত শব্দের বাংলা বানানে অবিকল্প /দন্ত্য-ন/ হয়। যেমন: ওয়ারেন্ট, এজেন্ট, জয়েন্ট ইত্যাদি।

২. ঋ র ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ:

তৎসম শব্দে /ঋ, র/র-ফলা/রেফ, ষ/ক্ষ/ প্রভৃতি বর্ণ বা ফলা-সমূহের পরবর্তী /দন্ত্য-ন/ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যেমন:

ঋ, ঋ-কার এর পর মূর্ধন্য-ণ: ঋণ, ঋণী, ঘৃণা, তৃণ, মসৃণ, মৃণাল;

র-এর পর মূর্ধন্য-ণ: অরণি, অরণ্য, অরুণ, অলংকরণ, আবরণ, আচরণ, আহরণ, উচ্চারণ, কারণ, করুণ, তরণী, তরুণ, তোরণ, ত্বরণ, দারুণ, ধরণী, ধারণ, ধারণা, পূরণ, পূরাণ, প্রেরণ, প্রেরণা, বরণ, বারণ, ব্যাকরণ, ভরণ, মরণ, রণ, শরণ, শরণার্থী, সাধারণ, সারণি, স্মরণ, হরিণ।
মজা: ধরণ শব্দটি তৎসম নয়; সে জন্য দন্ত্য-ন। দরুন অব্যয়টি ফারসি তাই দন্ত্য-ন। এমন আর একটি শব্দ: ধরনধারণ।

র-ফলার পর মূর্ধন্য-ণ: আমন্ত্রণ, ঘ্রাণ, চিত্রণ, ত্রাণ, নিমন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণ, পরিত্রাণ, প্রণতি, প্রণীত, প্রাণ, প্রাণী, ব্রণ, ভ্রূণ, মিশ্রণ, মুদ্রণ, যন্ত্রণা, শ্রেণী, স্ত্রৈণ।

রেফ-এর পর মূর্ধন্য-ণ: অর্থব, আকীর্ণ, উদ্‌গীর্ণ, কর্ণ, কীর্ণ, ঘূর্ণন, ঘূর্ণি, চূর্ণ, জীর্ণ, দীর্ণ, নির্ণয়, পর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণিমা, বর্ণ, বর্ণনা, বিকীর্ণ, বিদীর্ণ, বিস্তীর্ণ, শীর্ণ, স্বর্ণ।

মজা: রেফ-এর পর মূর্ধন্য-ণ হয় বলে তৎসম শব্দে সাধারণত রেফ-এর পর দন্ত্য-ন দেখা যায় না। তবে সাধিত শব্দে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন: দুর্নাম, দুর্নীতি, অহর্নিশ, দুর্নিবার ইত্যাদি।

মূর্ধণ্য-ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ: অণ্বেষণ, চূষণ, তোষণ, দূষণ, বিদূষণ, নিষ্পেষণ, পোষণ, পেষণ, বিশেষণ, বিশ্লেষণ, বিভীষণ, ভাষণ, ভীষণ, ভূষণ, শোষণ, কৃষাণ, পাষাণ, বিষাণ, আকর্ষণ, কর্ষণ, ঘর্ষণ, ধর্ষণ, বিকর্ষণ, বর্ষণ, এষণা, ঘোষণা, গবেষণা, বিষণ্ন।

ষ্ণ (ষ+ণ) এর পর মূর্ধন্য-ণ: কৃষ্ণ, ঈষধুষ্ণ, উষ্ণ, শীতোষ্ণ, তৃষ্ণা, কৃষ্ণা, ক্ষয়িষ্ণু, বর্ধিষ্ণু, চলিষ্ণু, জিষ্ণু, বিষ্ণু, সহিষ্ণু, বৈষ্ণব, উষ্ণীষ ইত্যাদি।

ক্ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ: ঈক্ষণ, ক্ষণ, ভক্ষণ, রক্ষণ, লক্ষণ, শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ, নিরীক্ষণ, পরীক্ষণ, বিচক্ষণ, বীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, সংরক্ষণ, সমীক্ষণ, দক্ষিণ, প্রদক্ষিণ, দক্ষিণা, তীক্ষ্ণ, ক্ষীণ, ক্ষুণ্ন।

৩. বর্ণ-বর্গ ও মূর্ধন্য-ণ

একই শব্দের মধ্যে /ঋ, র, র-ফলা, রেফ, ষ, ক্ষ/ এর যে কোনটির পর যদি স্বরবর্ণ, ক-বর্গের ৫টি (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের ৫টি ( প ফ ব ভ ম), এবং (য য় হ ং) প্রভৃতি বর্ণের এক বা একাধিক বর্ণ থাকে তাহলে পরবর্তী /দন্ত্য-ন/ ধ্বনি /মূর্ধন্য-ণ/ হয়ে যায়। যেমন:

অকর্মণ্য, আক্রমণ, আরোহণ, উৎক্ষেপণ, উপক্রমণিকা, কৃপণ, কৃপাণ, ক্ষেপণাস্ত্র, গ্রহণ, গৃহিণী, চর্বণ, তর্পণ, দর্পণ, দ্রবণ, দ্রাবণ, নিরূপণ, নির্বাণ, নিষ্ক্রমণ, পার্বণ, বৃংহণ, ব্রাহ্মণ, ভ্রমণ, ভ্রাম্যমাণ, ম্রিয়মান, রমণী, রামায়ণ, রুগ্ণ, রক্ষ্ণণ, শ্রবণ, শ্রাবণ, সন্তর্পণ, সংক্রমণ, সমর্পণ, সর্বাঙ্গীন, অর্পণ, প্রাঙ্গণ ইত্যাদি।

মজা: (ক) / ঋ, র, র-ফলা, রেফ, ষ, ক্ষ/ এর পর অন্যকোন বর্গের বর্ণ থাকলে পরবর্তী দন্ত্য-ন ধ্বনি /মূর্ধন্য-ণ/ হয় না। যেমন: অর্চনা, দর্শন, প্রার্থনা, রচনা, রটনা ইত্যাদি।

(খ) কোন কোন সন্ধিজাত ও সাধিত শব্দের ক্ষেত্রে /দন্ত্য-ন/ অপরিবর্তিত থাকে। যেমন: নিষ্পন্ন (নিঃ + পন্ন)।

(গ) শব্দের শেষে হসন্তযুক্ত /দন্ত্য-ন/ থাকলে তা মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন: ব্রহ্মন্‌, শ্রীমান্‌ প্রভৃতি।

৪. সাধিত শব্দে মূর্ধন্য-ণ:

সাধিত শব্দে (উপসর্গ, সন্ধি বা সমাসযোগে গঠিত শব্দ) /ঋ র ষ ক্ষ/ এর পরবর্তী /দন্ত্য-ন/ সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। তবে বিশেষ নিয়মে /দন্ত্য-ন/ কখনও কখনও মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়।

(ক). /পরি- -প্র- নির-/ এ তিনটি উপসর্গের পর দন্ত্য-ন থাকলে তা মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। যেমন: পরিণত, পরিণতি, পরিণয়, পরিণাম, পরিবহণ, প্রণত, প্রণাম, প্রণয়ন, প্রণিধান, প্রণিপাত, প্রণীত, প্রণোদিত, প্রবণ, প্রমাণ, প্রবাহিনী, প্রবীণ, নির্ণয়, প্রয়াণ এবং পরিণাম। ব্যতিক্রম: প্রনষ্ট, পরিনির্বাণ, নির্নিমেষ।

মজা:দুর্‌- উপসর্গের পর ণত্ব-বিধান প্রযোজ্য হয় না। দন্ত্য-ন অপরিবর্তিত থাকে। যেমন:দুর্নীতি, দুরপনেয়, দুর্নাম, দুর্নিবার, দুরন্বয় ইত্যাদি।

(খ). র, বা র-ফলার পর পরবর্তীপদে -অয়ন শব্দ থাকলে ঐ শব্দের /দন্ত্য-ন/ পরিবর্তিত হয়ে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যেমন: উত্তরায়ণ, চান্দ্রায়ণ, নারায়ণ, পরায়ণ, রবীন্দ্রয়ণ ইত্যাদি।

গ./অপর-, পরা-, পূর্ব-, প্র-/ প্রভৃতি উপসর্গের পূর্বপদের পর /অহ্ন/ শব্দ যুক্ত হলে ণত্ববিধান অনুসাতে /দন্ত্য-ন/ এর স্থলে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যেমন: অপরাহ্ণ, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, প্রাহ্ণ ইত্যদি। তবে অহ্ন, চিহ্ন, জাহ্নবী, সায়াহ্ন প্রভৃতি বানানে হ-যে দন্ত্য-ন হয়।

(ঘ). সাধিত শব্দ হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু শব্দে /র/ এর প্রভাবে /দন্ত্র-ন/ পরিবর্তিত হয়ে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়ে যায়। যেমন: অগ্রণী, গ্রামণী, গ্রামীণ ইত্যাদি। তবে অগ্রনেতা, অগ্রনায়ক প্রভৃতি শব্দে দন্ত্য-ন হয়।

(ঙ). কোন কিছুর নাম বুঝাতে এক শব্দ বলে বিবেচিত হলে সাধিত শব্দে ণত্ব-বিধান অনুযায়ী দন্ত্য-ন এর স্থলে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: অগ্রহায়ণ, শূর্পণখা ইত্যাদি।

মজা: গণনা অর্থে গণ ধাতু সহযোগে গঠিত শব্দে /মূর্ধন্য-ণ/ আবশ্যক। যেমন: গণক, গণনা, গণিত, গণৎকার, গণনীয়, গণ্য প্রভৃতি। সমূহ অর্থে গণ ধাতু যোগে গঠিত শব্দেও /মূর্ধন্য-ন? আবশ্যক। যেমন: গণতন্ত্র, গণশক্তি, গণনায়ক, গণজাগরণ, গণসংগীত, গণিকা, জনগণ ইত্যাদি।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

হিসাব আর হিসেবে / ড. মোহাম্মদ আমীন - শুবাচ