‘শুবাচী’ বাঙালি / ড. হায়াৎ মামুদ



‘শুবাচ’ প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভে আমি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। গুরুত্ব না- দেওয়ার কারণও ছিল। এরকম অনেক সংগঠন ও দল বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরাও এমন কম করিনি। প্রতিষ্ঠাকালে যে তেজ, উদ্যম, উৎসাহ ও একাগ্রতা দেখা যায় - তা কয়েকদিনের মধ্যে ভাটার তলানিতে নেমে আসে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উল্কার মতো হঠাৎ জ্বলে উঠে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবার নিভে যায়। উল্কার আলোর বেগ আছে, আবেগও থাকে, কিন্তু স্থায়িত্ব থাকে না। তাই  উল্কার আলো দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজ করা যায় না। আশঙ্কা ছিল হয়তো ‘শুবাচ’ও অনুরূপ হবে।




‘শুবাচ’ ও শুবাচের প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ আমীন আমার এ ভুল ভেঙে দেয়। যত দিন যেতে থাকে, ততই শক্ত, ও বিস্তৃত হতে থাকে শুবাচ এবং শুবাচের ডালপালা। অল্পসময়ের মধ্যে ‘শুবাচ’ প্রত্যাশিত লক্ষ্য অতিক্রম করে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ রা অক্টোবর একজন সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত শুবাচ-এর সদস্য সংখ্যা এখন ৬১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন বাড়ছে সদস্য, প্রতিনিয়ত বাড়ছে কার্যপরিধির ব্যাপকতা। দেশে-বিদেশে রয়েছে শুবাচের অনেকগুলো শাখা। পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাভাষী রয়েছে, সেসব দেশে রয়েছে শুবাচের সদস্য। সদস্যবৃন্দ অনলাইনের মাধ্যমে বাংলা শেখেন, বাংলা শেখান এবং বাংলায় কোনো প্রশ্ন দেখা দিলে শুবাচের মাধ্যমে তার সমাধান খুঁজে পান।শুবাচ এখন এখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর নিজস্ব উদ্দেশ্য আছে, নীতি আছে, স্বকীয়তা আছে। আমি মনে করি, শুবাচ প্রমিত বানান ও শুদ্ধ বাংলা শেখার সবচেয়ে বড় একক প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, আমি লক্ষ্য করে অবাক হয়েছি, ‘শুবাচ’ বাংলা বানান ও ভাষা শিক্ষার সাথে অপূর্ব কৌশলে আচরণগত মাধুর্য কীভাবে রক্ষিত হয়, তা-ও শিক্ষা দিচ্ছে।  আচরণ-শিক্ষায় তাদের স্লোগান : 
ভুল থেকে ফুল
ফুল থেকে মূল,
মূল থেকে বৃক্ষ
এটিই অন্তরীক্ষ।

ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষীর ও বাংলা ভাষার একটি গৌরবোজ্জ্বল দিক। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাংলা ভাষা দিবস নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। যাঁদের জন্য আমরা এ গৌরবে গৌরবান্বিত, তাঁদের ত্যাগ তখনই সত্যিকার মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে, যখন আমরা তাঁদের মতো গভীর আন্তরিকতায় মাতৃভাষার প্রতি নিবেদিত থাকব। এখন আমারা স্বাধীন জাতি। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাই ভাষার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার  প্রয়োজন এখন নেই।


কিন্তু রক্ত দিয়ে যাঁরা আমাদেরকে এ ভাষা দিয়ে গেছেন, তার পরিচর্যা আমাদের সর্বোচ্চ নৈতিক দায়িত্ব। পরিচর্যা ছাড়া কোনো কিছু টেকে না। তাই আমাদের মাতৃভাষার পরিচর্যা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর অনেক সমৃদ্ধ ভাষা কেবল উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলা ভাষাকে উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য ‘শুবাচ’ কাজ করে যাচ্ছে। বাগানের পরিচর্যার জন্য মালী প্রয়োজন। মালীহীন বাগান শ্রীহীন, নীরস ও পাণ্ডুর এবং আস্তে আস্তে জঙ্গলে পরিণত হয়। তেমনি পরিচর্যাহীন ভাষাও  ধীরে ধীর বিলুপ্ত হয়ে যায়। ‘শুবাচ’ বাংলা ভাষা নামের ফুলের বাগানে মালীর ভূমিকায় অবতীর্ণ।

বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় আমাদের আশপাশের দেশগুলো অধিকমাত্রায় ইংরেজির দিকে ঝুঁকছে। এমনকি গণচীনেও ইংরেজি
রপ্ত করার হিড়িক পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-প্রযুক্তি ও যোগাযোগের জন্য এছাড়া কোনো উপায় নেই। অগ্রগতি অর্জনের জন্য আমাদেরও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু সেটা কতটুকু এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তার সুস্পষ্ট সীমা নির্ধারণ প্রয়োজন। তবে, তা নিশ্চয়ই মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। বাংলাকে বাদ দিয়ে, বাংলাকে অবহেলা করে ইংরেজির প্রসার হবে আত্মহননের শামিল। ড. মোহাম্মদ আমীনের ভাষায়, “পর্ণকুটিরে ছিন্নবস্ত্রে বসবাসরত গর্ভধারিণীকে অবহেলা করে ধনী শাশুড়িকে নিয়ে মেতে থাকা আর যাই হোক, কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। ঠিক তেমনি মানুষের কাজ হতে পারে না মাতৃভাষাকে অবহেলা করে অন্যের ভাষা নিয়ে উল্লাস।” বস্তুত এমন লোকদের চরিত্র আঁকতে গিয়ে মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম বলেছেন :
যে সব বঙ্গেতে জন্মি
হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।

এ কারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। এ ভাষানীতি বাংলা ও ইংরেজির একটি সমান্তরাল সহঅবস্থান নিরূপণ করবে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবে। সুদৃঢ় ভাষানীতি না-থাকার কারণে আমরা প্রায় সবক্ষেত্রে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা প্রত্যক্ষ করছি। সরকারি দফতরগুলোতে যে-যার মর্জি-মতো করে বাংলায় নোট
লিখছেন। সরকারি দফতরে শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা বানানের একটি পত্রও  চোখে পড়ে না। যাঁরা এগুলো লেখেন তাঁরা উচ্চশিক্ষিত। নিজের ভাষার প্রতি যাঁরা এত অজ্ঞ তাঁদের উচ্চডিগ্রি নিয়ে সংশয় প্রকাশ অমূলক হবে না। সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছে শিক্ষায়তনগুলোতে। বাংলা বানানে কোথাও কোনো সমতা নেই। বাজারে প্রচলিত বিশেষজ্ঞ-লিখিত বানানেও রয়েছে সাংঘর্ষিকতা। এমনকি বাংলা একাডেমির বানান-রীতিতেও কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই। প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষানীতি থাকে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই তারা তা প্রণয়ন করেছে, অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা নেই। অথচ আমরা এ ভাষার জন্যই দিয়েছি জীবন।


     এ অবস্থায় ‘শুবাচ’ দলের ৬১ হাজারের অধিক সদস্য সারা বিশ্বে শুদ্ধ বাংলা বানান ও প্রমিত বাংলার প্রচার,



প্রসার ও বাংলার মান-প্রয়োগকে অর্থবহ এবং জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন - তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁদের এ উদ্যোগ সারা বিশ্বে বাংলাভাষীদের মনে একটি শুভ সূচনার ইঙ্গিত। অশুদ্ধ বানান ও বাক্য লেখার প্রবণতা গত কয়েক বছরে অনেক কমেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বাংলা লেখায় সবার মনে আগে যে একটা উন্নাসিক ভাব ছিল এখন তা নেই। সবাই ভুল সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠছে এবং মাতৃভাষাকে শুদ্ধভাবে লেখার ও বলার চেষ্টা করছে। যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। তবু ‘শুবাচ’ এর সদস্যবর্গের বাংলা ভাষায় এরূপ সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ এতবড় পরিসরে আরও কেউ নেয়নি। 
ভাষা বহমান নদীর মতো। তার গতিপথে কোনো বাধা এলে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। বানান ও বাক্যে যথেচ্ছাচার এবং মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা বাংলা নামক ভাষা-নদীর প্রধান বাধা। শুবাচের ৬১ হাজার সদস্য এ বাধা উপড়ে বাংলার ভাষার গতিকে সাবলীল রাখার গভীর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। শুবাচের সদস্যসংখ্যা বাড়ছে, তৎসঙ্গে বাড়ছে বাংলা ভাষার প্রসার, সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্য। হয়তো এমন একদিন আসবে, যেদিন সব বাংলাভাষী শুবাচী হয়ে যাবেন।  

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন