শুভঙ্করের ফাঁকি / ড. মোহাম্মদ আমীন

১৭২৯ খ্রিস্টা্ব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কোনো একটি অঞ্চলে, মতান্তরে বাকুড়া জেলায় ভৃগুরাম দাস নামের একজন গণিতজ্ঞ ছিলেন। তার পিতার নাম ছিলেন গঙ্গারাম দাস। গঙ্গারাম ছিলেন স্বভাবকবি এবং পাঠশালার বাংলা-পণ্ডিত। বিদগ্ধ সমাজে তার বেশ সুনাম ছিল। ভৃগুরাম দাস পিতার ন্যায় ছোটবেলা থেকে ছড়া কাটতে শেখে যান। তবে পাঠশালায় গণিত শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের কষ্ট ও ভীতি দেখে ভৃগুরাম তা দূরীভূত করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। অনেকে চিন্তার পর তিনি এর একটি উপায় খুঁজে পান। ভৃগুরাম, ছড়াকে গণিত শেখার উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে আনন্দের মাধ্যমে শিশুদের গণিত শিক্ষা দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি পাটিগণিতের অনেক জটিল নিয়ম শিশুদের জন্য সরল আর্যায় বা এক প্রকার বিশেষ ছন্দোময় ছড়া-কবিতায় পরিবর্তন করেন।কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ভৃগুরামকে তৎকালীন পণ্ডিত সমাজ “শুভঙ্কর” উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি গল্প ও ছড়ায় ছড়া শিক্ষার অজুহাতে ফাঁকি দিয়ে বেশ আনন্দের মাঝে গণিত শেখাতেন। এজন্য তার গণিত শেখানোর কৌশলকে অনেকে বলতেন : শুভঙ্করের ফাাঁকি। তাঁর কয়েকটি সরল আর্যা উত্তরসহ নিচে দেওয়া হলো:

১.
সরোবরে বিকশিত কমল নিকর।
মধুলাভে এল তথা অনেক ভ্রমর।।
প্রতি পদ্মে বসে যদি ভ্রমন যুগল।
অলিহীন রহে, তবে একটি কমল।।
একেক ভ্রমর বসে প্রত্যেক কমলে।
বাকী রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে।।

উত্তর: পদ্ম সংখ্যা X ও ভ্রমর সংখ্যা Y হলে, প্রশ্নানুসারে।
Y=2(X-1)…..(i)
Y=X+1…….(ii)
(i) ও (ii) সমাধান করে, x=3, y=4
সরোবরে 3 ও টি পদ্ম ও 4 টি ভ্রমর এসেছিল।

২.
ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক স্থানে।
চুড়ায় উঠিত এক কীট করে মনে।।
দিবাভাগে দশ হত উঠিতে লাগিল।
নিশাযোগে অষ্ট হাত নীচেতে নামিল।।
না পায় যাবৎ চুড়া করে সে অটন।
কত দিনে উঠেছিল কর নিরুপণ।।

উত্তর: এখানে এক বুক পুরো দিনে (দিন ও রাত) কীট মোট দুহাত ওঠে। তার ওঠার শেষ দিকে দিবাভাগে যে শেষ দশ হাত উঠলে চূড়ান্ত ওঠা হবে। বাকি (বিশ) হাত কীট ওঠা-নামা করেছিল বা 10 দিন।
অতএব, মোট সময় লাগবে পুরো 10 দিন + একটি দিবাভাগ = 10 দিন।

৩.
জমা হুয়া যেত্তা সেপাই।
হুগলি গিয়া উসকা তেহাই।।
পদনা-পার গিয়া আধ।
দশমা ভাগ জাহানবাদ।।
বাকী রহা এক হাজার।
কেত্তা সেপাই কহ জমাদার।।

উত্তর: মনে করি সিপাহী সংখ্যা = X
প্রশ্নমতে,
=> 10X + 15X + 3X+1000=30X
=> 2X=30000
=> X=15000
অতএব মোট সিপাহী সংখ্যা 15000 জন।

৪.
দুই বৃক্ষে দুই পারাবত বসি।
একটি অন্যের প্রতি কহিছে সম্ভাষি।।
যদ্যপি একটি আসে তব দল হতে।
তোদের ত্রিগুন হই তাহার সহিতে।।
অন্য বলে, যোগে মোরা সম হতে পারি।
এক পক্ষী আসে যদি তব দল ছাড়ি।।
প্রতি দলে ছিল কত কপোত বসিয়া।
প্রকৃত উত্তর দেহ হিসাব করিয়া।।

উত্তর : মনে করি দুই দলের পারাবত সংখ্যা যথাক্রমে x ও y ,
সুতরাং প্রশ্নমতে,
X+1=3(Y-1)...........(i)
এবং
x-y=y+1………………….(ii)

সমীকরণ (i) ও (ii) এর সমাধান করে পাই
x=5,
y=3’
অতএব দুটি দলের পারাবত সংখ্যা ৫ ও ৩

৫.
এক গোষ্ঠী ত্রিপথগামী,
সপ্তঘাটে গিয়ে পানি।
দ্বাদশ গোপে গাভী দোয়।
নবকৃক্ষের তলায় শোয়।
(গাভী সংখ্যা= ?)

উত্তর: এখানে বর্ণিত
ত্রিপথগামী = ৩
সপ্তঘাট = ৭
দ্বাদশ গোপ = ১২ এবং
নবকৃষ্ণের তলায় = ৯
অতএব গোষ্ঠের গাভী সংখ্যা এমন হবে যা ৩,৭,১২ ও ৯ দ্বারা বিভাজ্য অর্থাৎ নির্ণয়ে সংখ্যা ৩,৭,৯ ও ১২ এর সাধারণ গুনিতক।
অতএব ৩,৭,৯ ও ১২ এর ল,সা,গু ২৫২ হলো গাভীর সংখ্যা।

৫.
আছিল দেউল এক ইচিত্র গঠন।
ক্রোধে জলে ফেলে দিল পঠন নন্দনা।।
অর্ধেক পাঙ্কেতে তার তেহাই সলিলে।
দশম ভাগের ভাগ শেওলার দলে।।
উপরে দ্বাদশ গজ রহে বিদ্যমান।
কর শিশু দেউলের উচ্চতা প্রমাণ।।

উত্তর :

(তেহাই= তিন ভাগের এক)
উত্তর : মনে করি, দেউলের উচ্চতা = x গজ
তাহলে শর্তমতে,
x/2+x/3+x/10+12= x
=> 15x+10x+3x+360=3x (উভয় পক্ষকে 2,3,10 এর ল,সা,গু 30 দ্বারা ভাগ করে)
=> 2x=360
=> 180
অতএব, দেউল বা দেওয়ালের উচ্চতা ১৮০ গজ।

৬.
কুড়োল বাটাল বাইশখান,
চোরে নিল তিনখান
বাকি রইল কয়খান?

উত্তর : একটিও নেই। কুড়োল, বাটাল ও বাইশ- তিনটাই চুরি গেছে।

৭.
এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছিল। গাছে-বসা একটি পাখি বলল :
তোমরা কয়জন?
উড়ন্ত পাখিদের দলনেতা বলল :
আছি যতো, আরও ততো
তার অর্ধেক, তার পাই
তোরে নিয়ে শত পুরাই।
বলুন তো ওই ঝাঁকে কয়টা পাখি ছিল?

উত্তর : মনে করি পাখির সংখ্যা = ক
প্রশ্নমতে, ক+ক+১/২ক+ ১/৪ক+১ =১০০
বা ১১ক/৪= ১০০-১
বা ১১ক/৪= ৯৯
বা ক =৩৬।
উড়ন্ত পাখির সংখ্যা ৩৬।
--------------------------------------------------------------
প্রয়োজনীয় লিংক
শুবাচ লিংক
শুবাচ লিংক/২
শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/১
শুদ্ধ বানান চর্চা লিংক/২

Comments

  1. জানার সুযোগ হল, ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. শুভঙ্করের আর্যা ছড়া আমি মায়ের থেকে শুনেছি।

    ReplyDelete
  3. জেনে ভালো লাগলো । মজার মজার এমন জিনিস আরো জানতে চাই !!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. জানার খুব ইচ্ছা ছিল, শুভঙ্কর কী ফাঁকি দিয়েছিল। আজ জেনে খুব ভাল লাগছে। অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন