দেখার ভয়ে চোখ নষ্টকরণ / অভিজিৎ অভি


শুবাচ গ্রুপে বহু পোস্ট দেখতে পাই যে বাংলা ভাষায় দুটো ন (ণ আর ন), তিনটি শ (শ,ষ,স) থাকায় বানানে অনেক জটিলতা সৃষ্টি করে। একটা রেখে বাকি বর্ণগুলো ফেলে দিলে বাংলা ভাষা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এই দাবিটি কতটুকু যৌক্তিক?
আমরা সবাই ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে জানি। ইংরেজি বর্ণমালায় বর্ণের সংখ্যা বাংলার প্রায় অর্ধেক। ইংরেজি ভাষায় মোট ধ্বনি ৪৪টি, অথচ বর্ণ ‍২৬টি। এক বর্ণ দিয়ে তারা একাধিক ধ্বনির কাজ চালায়। এইরকম চরম বর্ণসংকটে থাকার পরেও ইংরেজি ভাষায় একটা ধ্বনির জন্য একাধিক বর্ণ (বা বর্ণগুচ্ছ) ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলায় ‘ক’ ধ্বনির জন্য কেবল ক ব্যবহৃত হয়; অন্যদিকে ইংরেজিতে ‘ক’ ধ্বনির জন্য c(cat), k(king), q(queen), ck(duck), ch(stomach) এইপ্রকার পাঁচটি বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ব্যবহৃত হয়। যদি শব্দগুলো কেবল k দিয়ে লেখা হয় (kat, king, kueen,duk, stomak) তাহলে কি ইংরেজি ভাষা আরও সরল হবে না? কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন ইংরেজ এমন চিন্তা করেন নি।
বাংলা ছাড়া হিন্দি, মারাঠি, সিন্ধি, বিহারি, ভিলি, মারওয়ারি, কোংকনি, ভোজপুরি প্রভৃতি ভাষাতেও ণ এবং ন বিরাজমান। এতগুলো ভাষা যদি দুটি ণ নিয়ে চলতে পারে, তবে আমরা কেন পারব না?
__ক__।। __খ__।। __গ__।। __ঘ __।।___ ঙ
__চ__।। __ছ__।। __জ__।। __ঝ __।।___ ঞ
__ট__।। __ঠ__।। __ড__।। __ঢ __।।___
__ত__।। __থ__।। __দ__।। __ধ __।।___ ন
__প__।। __ফ__।। __ব__।। __ভ __।।___ ম
উপরে দেখুন বর্গীয় বর্ণের সৃশৃঙ্খল বিন্যাস। সবার আপদ ণ কে মুছে দেয়া হল। কেমন লাগছে এখন দেখতে? যেন সোনার মুকুটের একটি রত্ন খসে গেছে।
যারা বলবেন এখানে ফাঁকা থাকবে কেন, পরের বর্ণ সামনে চলে আসবে; তারা দেখুন
__ক__।। __খ__।। __গ__।। __ঘ __।।___ ঙ
__চ__।। __ছ__।। __জ__।। __ঝ __।।___ ঞ
__ট__।। __ঠ__।। __ড__।। __ঢ __।।___ ত
__থ__।। __দ__।। __ধ__।। __ন __।।___ প
__ফ__।। __ব__।। __ভ__।। __ম __।।___
আগে আমরা বলতে পারতাম বর্গের ১ম ও ৩য় বর্ণ অল্পপ্রাণ, ২য় ও ৪র্থ বর্ণ মহাপ্রাণ আর ৫ম বর্ণ নাসিক্য। এখন আর তা বলার উপায় নেই। রসায়নের পর্যায় সারণির কোন একটি মৌল যেমন বাদ দেয়া যায় না, বর্গীয় বর্ণের সুসংহত বর্গটিও তেমন।
কিছু শব্দে কেবল ণ,ন এর জন্য পার্থক্য হয় যেমন মণ, মন; আপণ, আপন। ণ তুলে দিলে এসব শব্দের পার্থক্য করা সম্ভব নয়।
ণ তুলে দিলে আমরা ণ্ড, হ্ণ, ষ্ণ, ক্ষ্ণ প্রভৃতি দৃষ্টিনন্দন যুক্তবর্ণ হারিয়ে ফেলব। এটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
সময়ের সাথে কিন্তু ণ এর ব্যবহার কমে এসেছে। একদা ক্রিয়াপদে (লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ- চর্যাপদ) এবং বিদেশী শব্দে (প্যাণ্ট, ঠাণ্ডা) ণ ব্যবহৃত হত, এখন আর হয় না। কিন্তু তাই বলে ণ বাদ দিয়ে ভাষা সরল করা যেন সোনার তাজ ফেলে দিয়ে মাথার বোঝা কমানো।
আসলে ভাষা শিখতে হয়, না শিখে তা আয়ত্ত করা যায় না। আমরা ভাষা না শিখে ভাষার সমালোচনা করি, বলি বাংলা ভাষায় দুটা ন, তিনটা স, তিনটা র- তাই ভাষাটা জটিল- আর তাই বাংলা লিখতে আমার ভুল হয়। এগুলো আসলে নিজেদের না শেখার প্রবণতাকে সমর্থন দেয়ার অজুহাত। পৃথিবীর কোন ভাষাই নিজের কাঠিন্য দূর করতে নিজের বর্ণ বিলোপ করেনি। যদি ভাষায় বর্ণের ব্যবহার না থাকে তবে তা আপনিই বাদ হয়ে যায়- যেমন বাংলায় ৠ আর ৶ বর্ণদ্বয়ের ব্যবহার না থাকায় এগুলো ইতোমধ্যে বর্জিত হয়েছে।
আমি সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারি না, তাই স্যার আনিসুজ্জামানের কাছ থেকে কিছুটা ধার করছি। স্যার বলেন “প্রকৃতপক্ষে, মাতৃভাষাও শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে হলে তা শিখতে হয়, চর্চা করতে হয়, পৃথিবীর সব জাতি তা-ই করে। শুধু আমরা করি না...... নিষ্ঠুর হলেও সত্য যে, আমরা নিজেদের অক্ষমতা বা ঔদাসীন্যজনিত অপরাধের বোঝা মাতৃভাষার ওপরে চাপিয়ে মনকে চোখ ঠারি। বাংলা নাকি খুব কঠিন ভাষা, বানান নাকি ভয়ানক শক্ত ও ভজঘট! আমাদের জননীর মতো মাতৃভাষাও সর্বংসহা, সন্তানের দেওয়া এই অন্যায় অপবাদের বিরুদ্ধে সে কথা বলে না। ”

Comments

Popular posts from this blog

উপলক্ষ ও উপলক্ষ্য

পার ও পাড় / ড. মোহাম্মদ আমীন

তৎসম চেনার কৌশল / ড. মোহাম্মদ আমীন